রাকিবুল হাসান:
কানপুরে প্রাচীন একটি মাদরাসা ছিলো। নাম—মাদরাসায়ে ফয়জে আম। মাদরাসাটির সদরে মুদাররিস মাওলানা আহমদ হাসান যুক্তিশাস্ত্রে ছিলেন বিশেষ দক্ষ এবং অভিজ্ঞ। কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি এ মাদরাসা ছেড়ে দেন। অন্যত্র গিয়ে ‘দারুল উলূম’ নামে নতুন একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি যে পরিমাণ অভিজ্ঞ এবং ছাত্রদের কাছে যে পরিমাণ শ্রদ্ধার ছিলেন, তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে তেমন যোগ্য কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলো না মাদরাসায়ে ফয়জে আম কর্তৃপক্ষ। কেউ ইচ্ছে করে এ পদের জন্য আবেদন করার সাহসও করছিলো না। তখন দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে সদ্য পড়ালেখা শেষ করেছেন হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবি রহ.। কানপুর মাদরাসা থেকে উক্ত পদের জন্য তার নিকট প্রস্তাব আসে। আগে কখনও তিনি শিক্ষকতা করেননি। পড়ালেখা শেষ করা তরুণ একজন আলেম। নিজের উসতাদ এবং পিতার পরামর্শ এবং অনুমতিক্রমে তিনি ১৩০১ হিজরির সফর মাসে কানপুর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার শিক্ষকজীবন শুরু হয় পঁচিশ রূপি বেতনে। তখনকার সময়ে এই বেতন নেহাত কম ছিলো না। থানবি রহ.-এর বলেন, ‘দশ রূপি বেতনই আমার জন্য আমি যথেষ্ট মনে করতাম৷ পাঁচ রূপি নিজের খরচ, পাঁচ রূপি পরিবারের খরচ। দশ রূপির বেশি বেতনের কথা কল্পনাও করতাম না। এর বেশি বেতনের যোগ্যও নিজেকে মনে করতাম না।’
সাহস ও স্বপ্ন
শিক্ষক জীবনের শুরুতেই থানবি রহ.কে পড়াতে দেয়া হয় বড় ক্লাসের বড় বড় কিতাব। প্রথম প্রথম ঘাবড়ে গেলেও দোয়ার বদৌলতে তিনি সাহস অনুভব করেন। দরসে পড়াতে থাকেন বেশ সাবলীলভাবেই। মাঝেমধ্যে অনুভব করতেন, অদৃশ্য থেকে কেউ তার সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছেন। অন্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রশান্তি।
এ সময় তিনি দুটো স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন তার শিক্ষকতার গতি বাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, ‘আমি যখন হাদিসের দরস শুরু করি, তখন স্বপ্নে একবার আমার উসতাদ মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব রহ.কে দেখি। দেখি—বুখারী শরীফের একদল ছাত্র আমার সামনে বসা। দেখে দেখে আমি তাদেরকে বুখারী শরীফ পড়াচ্ছি। আমার উসতাদও আমার সামনে বসে আছেন। সম্ভবত তার নিকটও বুখারী শরীফ আছে। আমি যা বয়ান করি, আমার উসতাদ তার ব্যাখ্যা করেন।’
আরেকদিন স্বপ্নে দেখি—জামিউল উলুম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা জনাব আবদুর রহমান খানের ভিটায় একটি কূপ। কূপের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদি.। আমিও তার নিকট দাঁড়িয়ে আছি। এরপর তাফসিরশাস্ত্রের প্রতি আমার আগ্রহ প্রবল হয়।’
হজরত থানবি রহ. এমন একনিষ্ঠতার সঙ্গে পড়াতে থাকেন, কানপুরে তার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে যায় দু’তিন মাসেই। তার দরস-তাদরিসে মুগ্ধ হয়ে যায় ছাত্ররা; বয়ানে-নসিহতে অনুরক্ত পড়ে সাধারণ জনতা।
কানপুর থেকে ইস্তফা, নতুন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা
থানবি রহ.-এর এই জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে চায় মাদরাসা কমিটি। তারা তার নিকট চাঁদা কালেকশনের আবেদন করলো। তিনি না করে দিলেন। কারণ, তিনি এভাবে চাঁদা কালেককশন বরকতহীন, আত্মমর্যাদা পরিপন্থী এবং নাজায়েজ মনে করতেন। প্রত্যাশা মোতাবেক চাঁদা কালেকশন না করায় কমিটি থানবি রহ.কে নিয়ে কানাঘুষা করতে থাকে আড়ালে-আবডালে। বিষয়টি থানবি রহ.-এর কানে গেলে তিনি মাদরাসা থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। অনেক অনুরোধ করা সত্বেও তিনি আর থাকেননি। গ্রামে চলে যাবার আগে তিনি দেখা করতে যান মাওলানা শাহ ফজলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদীর সঙ্গে।
এদিকে থানবি রহ. চলে যাওয়ায় ছাত্রদের মধ্যেও হতাশা তৈরী হয়। জনাব আবদুর রহমান খান এবং হাজি কেফায়াতুল্লাহ পরামর্শ করেন, এমন মাওলানা পাওয়া মুশকিল হবে। তাকে চলে যেতে দেওয়া যাবে না। দরকার হলে তার জন্য নতুন মাদরাসা কায়েম করা হবে। আমাদের শহরের মাদরাসাগুলোতে মানতেক বেশি পড়ানো হয়। এমন একটি মাদরাসা দরকার, যেখানে দিনিয়াত বিষয়গুলো পূর্ণ শেখানো হবে। কানপুরে থানবি রহ.-এর বেতন ছিলো পঁচওশ রূপি। তারা দুজন সিদ্ধান্ত নেন, এখানেও তাকে পঁচিশ রূপি বেতন দেয়া হবে। খান সাহেব দিবেন বিশ রূপি, হাজি সাহেব পাঁচ রূপি।
গঞ্জে মুরাদাবাদীর দরবার থেকে ফিরে গ্রামের পথ ধরেন থানবি রহ.। কানপুরে তার পথ আটকালেন খান সাহেব এবং হাজি সাহেব। তাদের মিনতি তিনি ফেলে দিতে পারলেন না। টপকাপুর মহল্লার জামে মসজিদে তিনি দরস দিতে শুরু করলেন। এভাবেই ভিত্তি স্থাপিত হয় নতুন মাদরাসার। মসজিদের সঙ্গে মিল রেখে মাদরাসার নামকরণ করা হয়—জামিউল উলূম।
শিক্ষকতার দিন চলতে থাকে। একসময় থানবি রহ.-এর মনে ভাবনার জন্ম হয়—আল্লাহর কাজ আল্লাহর জন্যই শুধু করা উচিত। এই কাজে বেতন নেয়া একবারেই অনুচিত। এই ভাবনার সমাধান হিসেবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, চিকিৎসা বিদ্যা শিখে এর মাধ্যমে তিনি জীবীকা নির্বাহ করবেন। বিদ্যা শিখতে তিনি হাকিম আবদুল মজিদ খানের চলেও যান। কিন্তু পনেরো দিনের বেশি তিনি সেখানে থাকতে পারেননি। কানপুরবাসীর আবেদনে তিনি আবার কানপুরে ফিরে আসেন। তার ফিরে আসায় হাজি সাহেব রহ.-ও অত্যন্ত আনন্দিত হন।
এখানে টানা ১৪ বছর দরস-তাদরিসে মশগুল থাকেন। তারপর ১৩১৫ হিজরিতে তিনি কানপুর ছেড়ে স্থায়ীভাবে থানাভবনে বসবাস শুরু করেন।
থানবি রহ.-এর শিক্ষানীতি
থানবি রহ.-এর শিক্ষক জীবন এবং বক্তব্য পর্যবেক্ষণ করলে তার শিক্ষানীতিগুলো স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি যথাসাধ্য মেহনত করে সবকের বিষয়গুলো আগে নিজে আয়ত্ব করতাম, তারপর পড়াতাম। এতে আমার কষ্ট হলেও ছাত্রদের জন্য সহজ হতো। এভাবে পড়ালে কঠিন থেকে কঠিন বিষয় ছাত্রদের জন্য সহজ হয়ে যায়।’
দরসে নিজের পড়ানোর পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের সামনে আমি প্রয়োজনের অতিরিক্ত তাকরির করতাম না। মূল অলোচনা উপস্থাপন করে কিতাব বুঝিয়ে দিতাম। অতিরিক্ত আলোচনা করে ছাত্রদের সময় নষ্ট করিনি কখনো৷’
সপ্তাহব্যাপী সময় নিয়ে ছাত্রদেরকে বিতর্ক শেখাতেও নিষেধ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এতে ছাত্রদের মন বিতর্ক-বহসের প্রতি ধাবিত হয়, মূল দরস থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এগুলো শেখার সপ্তাহব্যাপী সময়ের দরকার নেই। বরং কিতাবের সিলেবাস শেষ হলে বহস-বিতর্ক এমনিতেই শেখা হয়ে যায়। তা না হলে সিলেবাসই অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।’
উসতাদের সঙ্গে ছাত্রদেরও কর্তব্য রয়েছে। তিনি বলেন, ‘একজন ছাত্রের যোগ্যতা সৃষ্টির জন্য তিনটি বিষয় আবশ্যক। এক—ক্লাসে উসতাদ যা পড়াবেন, তা আগেই একবার পড়ে আসা। যেন কোনটা বুঝে না, তা নির্ণয় করা যায়। দুই—উসতাদ যখন সবক পড়াবেন, সবক না বুঝে সামনে অগ্রসর না হওয়া। ক্লাসে উসতাদকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ না পেলে ক্লাসের বাইরে কোনো সময় গিয়ে জিজ্ঞেস করবে। তিন—সবক বুঝে এলে নিজে নিজে একবার তার তত্ত্ব ও তথ্য আলোচনা করা। এই তিনটি কাজ যে করবে, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, তার যোগ্যতা সৃষ্টি হবেই।’
থানবি রহ.-এর কয়েকজন ছাত্র
১. মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক বারদাওয়ানি: থানবি রহ. জামিউল উলূম কানপুর থেকে ফেরার সময় তাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে এসেছিলেন। থানবি রহ.-এর মতো করে দীর্ঘদিন তিনি মাদরাসা পরিচালনা করেন। সেখান থেকে ধর্মীয় শিক্ষক হয়ে চলে আসেন কলকাতা আলিয়ায়। কলকাতা আলিয়া থেকে চলে আসেন ঢাকা আলিয়ায়। তিনি যখন অবসরে যান, তার বেতন ছিল ৫০০ রূপি।
২. মাওলানা রশিদ সাহেব কানপুরি: থানবি রহ. কানপুর থেকে ফেরার সময় মাওলানা ইসহাককে বানিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক এবং তাকে বানিয়েছিলে দ্বিতীয় শিক্ষক। তিনি ফিকহশাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি খুব বেশি বয়স পাননি।
৩. মাওলানা আহমদ আলী: তিনি ছিলেন ফিকাহ শাস্ত্রের পন্ডিত। গাঙ্গুহী রহ. তার ফিকহি যোগ্যতার প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘ফিকহের সঙ্গে তার খুব জানাশোনা রয়েছে।’ বোহেশতি জেওরের প্রথম পাঁচ খণ্ড তিনি থানবি রহ.-এর নির্দেশেই লিখেছিলেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন থানবি রহ. এর এজাজতপ্রাপ্ত প্রথম খলিফা। তিনিও কম বয়সে ইন্তেকাল করেন।
৪. মাওলানা সাদেকুল ইয়াকিন: তিনি ছিলেন গাঙ্গুহী রহ.-এর খলিফা। সে হিসেবে তিনি থানবি রহ.-এর পীরভাই। বড় বেশি মুত্তাকি ছিলেন তিনি। একবার তিনি থানবি রহ.কে বলেছিলেন, ‘আমার আশঙ্কা হয়, আল্লাহ তায়ালা না জানি আমাকে জিজ্ঞেস করে বসেন, তুমি এত বেশি মুত্তাকী কেন?’
৫. মাওলানা ফজলে হক : থানবি রহ.-এর ছাত্রদের মধ্যে সর্বপ্রথম শিক্ষা সমাপ্ত করেন তিনি। তিনি কুনুযে শিক্ষকতা করতেন।
৬. মাওলানা হাকিম মুহাম্মদ মুস্তফা বিজনুরী: তিনি আরবি সাহিত্য ও যুক্তিবিদ্যায় দক্ষ ছিলেন। থানবি রহ.-এর বয়ান শুরু করলেন, অত্যন্ত সাবলীলভাবে তিনি আরবি ভাষায় অনুলিখন করতেন। পরে এগুলো উর্দুতে অনুবাদ করতেন। মুনাজাতে মাকবুলের উর্দু অনুবাদ এতটা নিখুঁতভাবে তিনি করেছেন, থানবি রহ. এই অনুবাদের প্রশংসা করতেন অধিকাংশ সময়। থানবি রহ.-এর বয়ান অনুলিখন সর্বপ্রথম তিনিই শুরু করেছিলেন।
৭. মাওলানা যফর আহমদ উসমানী: ইনি থানবি রহ.-এর ভাগ্নে ছিলেন। তার ইলমের ওপর থানবি রহ.-এর আস্থা ছিলো। এজন্য ‘এলাউস সুনানে’র মতো জটিল ইলমি কাজ তার মাধ্যমে করিয়েছেন। এ কাজটি শেষ হলে থানবি রহ. অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন পাকভারত উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান আলেম।
ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসা
শিক্ষক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হজরত থানবি রহ.-এর ছাত্রদের প্রতি বিশেষ টান ও স্নেহ ছিলো। তিনি বলতেন, ‘ছাত্রদের প্রতি আমার যে ভালেবাসা, মুরিদ ও অনুসারীদের প্রতি ততটুকু নেই। ছাত্ররা সন্তানের মতো। ছাত্র ও উসতাদের সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ় ও মজবুত হয়ে থাকে। আর অনুসারীদের অধিকাংশের সম্পর্কেরই কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
ছাত্রদের দিয়ে তিনি কখনো ব্যক্তিগত কাজ করাতেন না। শিক্ষকদেরও এর অনুমতি দিতেন না। সাধারণ কোনো ব্যক্তির জন্য অনুমতি ছিল না, কোনো ভুলের কারণে ছাত্রদেরকে তিনি সতর্ক করবেন৷ কেউ অমন আচরণ করলে তিনি সহ্য করতেন না। তিনি বলতেন, ‘কারো ছাত্রদের প্রতি অভিযোগ থাকলে শিক্ষককে জানাবে। শিক্ষকরা সমুচিত শাস্তি দিবেন।’