
ইসহাক নাজির:
প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা। আরবের মাটি তখন অন্যায়-অপরাধ আর পাপাচার-অনাচারে উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছিল। শত শত বছর ধরে পৌত্তলিকতা, অশ্লীলতা, শিরক, বিদআত ও বহুত্ববাদের জমাট অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল আরব্য উপত্যকার আকাশ-বাতাস। জাহেলিয়াতের নানাবিধ ঘৃণ্য এবং অসুস্থচর্চায় নৈতিক অবক্ষয়ের পথে পুরোপুরি পিছলে গিয়েছিল সমাজ। ইয়াতিম-গরিবের সম্পদহনন কিংবা একের মাল অপরে বলপূর্বক হাতিয়ে নেয়াটা তথাকার সভ্যতার অহঙ্কার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল।
ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বতোভাবে পর্যুদস্ত সমাজের চিত্রই যখন এক, যখন মানবিক বিপর্যয়ে জর্জরিত ও পরাজিত হয়েছিল গোটা সিস্টেম, তখন জীবনবারি হিসেবে এমন এক সঞ্জীবনীর প্রয়োজন অনুভূত হলো, খাদে পড়া এই পঙ্গু ও নতজানু সমাজটাকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যার ভূমিকা হবে শেষ বিকেলে হাল ধরা নাবিকের ন্যায়।
হলোও তাই। একদা দিবানিশির সন্ধিক্ষণে আলোর ফুল হিসেবে প্রস্ফুটিত হলেন এক মহামানব। কালের কোলে শোভিত হলেন একজন মহীরুহ রূপে। যার নৈতিক আলো ও আত্মিক আলোড়নে আলোকিত হলো সাগর-ভূধর, ঝরনা-নহর। আলোড়িত হলো গোটা জগত-সংসারের সবটাই। যার ছায়ায় আশ্রিত হলো মানব-দানব নির্বিশেষে অবোধ পশু-পক্ষিকুল। শুধু আরব্য উপদ্বীপই নয়, বরং গোটা পৃথিবীর দিগ্বিদিকে আঁধার-ঘোরে নিমজ্জিত মানবতার মুক্তির পরোয়ানা হাতে এগিয়ে এসেছিলেন কাঙ্ক্ষিত সেই স্বর্গদূত। ইতিহাস এ-কথা অস্বীকার করার কোন জো নেই।
শৈশবের সেই সাতসকাল থেকেই বেড়ে ওঠেছিলেন অন্য দশটি শিশু হতে আলাদা ও অনন্য হয়ে। কৈশোরের দুরন্তপনায় চষে বেড়ানো পাড়ার আর সকল বাচ্চাদের মতো সারাদিন নদীর ধারে কিবা গাছের ডালে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন না তিনি। ফুলের মতো কোমল স্বভাবে কোন রুক্ষ্মতা ছিল না৷ ছিলেন আকাশের মতো মহানুভব, পাহাড়ের মতো প্রশান্ত আর ভোরের আলোর মতো অম্লান। ছিলেন মানুষ, অথচ মনুষ্যত্বেরও উর্ধ্বে। সাগরের মতো তার বিশালতায় ক্ষুদ্র বলতে কিছুমাত্রও ছিল না।
প্রাণসমৃদ্ধ পৃথিবীবাসীর তরে দয়াময়ের শ্রেষ্ঠতর উপহার ছিলেন তিনি। মহান কারিগরের সুনিপুণ হাতে সৃজিত অসামান্য সৃষ্টি। সততা ও সহমর্মিতা, স্বচ্ছতা ও নিষ্কলুষতা এবং আমানতদারিতা ও পরোপকারিতার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠলেন অসীম। সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে শিরা-উপশিরায় বন্দিত ও নন্দিত হলেন আল-আমীন উপাধীতে।
ছিলেন মহান আদর্শের উজ্জ্বলতম প্রতিক। উন্নত আদর্শ প্রতিষ্ঠায় প্রধান এবং আপসহীন রাহগীর। আদর্শহীনতায় কুঁকড়ে মরা নতজানু একটি সমাজে দাঁড়িয়ে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মহান আদর্শের প্রতি আহ্বান করে গেছেন। দেখিয়ে গেছেন আদর্শের প্রসার ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী করে আপসহীন থাকতে হয়। সুদূর ভবিষ্যতেও পরিবারের নিতান্তই গোপন আদর্শের প্রশ্নে যেন কোন উম্মাতকে সন্দিহান হতে না হয়, সে দিক বিবেচনা করতঃ উন্মোচিত করেছেন আঁধারের সুপ্ত অভিসারে পারিবারিক বদ্ধ জীবনের আদর্শিক ইতিবৃত্ত।
নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মহান অবিসংবাদিত নেতা। যুদ্ধের ময়দানে সুদক্ষ সমরকুশলি; হার না মানা সদাজাগ্রত অকুতোভয় সিপাহসালার। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতারণা ও পৃষ্ঠপ্রদর্শন না করে শত্রুকে কী করে দিকভ্রান্ত করতে হয়, পৃথিবীকে শিখিয়ে গেছেন চোখে আঙুল করে। একাল-ওকাল প্রতিটি যুগের তাবৎ যুদ্ধের ইতিহাসে পরাজিত বন্দীদের প্রতি যেই পৈশাচিক কর্মযজ্ঞের আগ্রাসন চালানো হয়, নারীদেরকে যৌনসঙ্গী ও শিশুদেরকে মাতৃক্রোড় থেকে পৃথক করে বাজারে বিক্রয় করা ইত্যাদি সব ঘৃণ্য সংস্কৃতির ইতি ঘটিয়ে সেখানে এক মহান রীতির প্রচলন ঘটিয়েছেন। বন্দী নারীর প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শনের এহেন উপমা পৃথিবী দ্বিতীয়টি আর দেখাতে পারবে না।
ছিলেন লজ্জাশীল। লজ্জা ছিলো তাঁর চারিত্রিক ভূষণ। তাঁর লাজরাঙা দু চোখের পানে তাকাতে স্বয়ং আকাশও লজ্জাবোধ করতো। একদা কাবার নির্মাণকাজে মাথায় করে পাথর বয়ে নিয়ে আসার সময় তাঁর কষ্ট হচ্ছে ভেবে চাচা আব্বাস তাঁর লুঙ্গি ধরে হেঁচকা টান দিতেই অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। আবার কাপড় জড়িয়ে দিতেই ঘোর কেটে যায় এবং কাপড় ঠিকঠাক করে উঠে দাঁড়ান। আকাশবাসী ফেরেশতারাও সেদিন বুঝি অবাক বিস্ময়ে একজন যুবকের লজ্জাশীলতায় মুগ্ধ হয়েছিল–এমনই লজ্জাশীল ছিলেন তিনি।
কথোপকথনে তিনি ছিলেন সদালাপী। সচেতনতার সাথে প্রতিটি শব্দ-বাক্য প্রয়োগ করতেন। কখনো দূর্বোধ্য কিংবা কঠিন শব্দ ব্যবহার করতেন না। যার সাথে কথা হচ্ছে, তার দিকে পুরোপুরি ঘুরে বসতেন। বাঁকা চোখে কিংবা মুখ ঘুরিয়ে তাকানো ছিলো তাঁর স্বভাববিরোধী। অন্যের কথা পূর্ণ মনোযোগ ও আগ্রহের সাথে শোনতেন এবং পূর্ণ আস্থা ও নির্ভরতার অভয় দিতেন।
জালিম কর্তৃক হাজারো কষ্ট পাওয়া সত্ত্বেও অত্যাচারের উত্তপ্ত মরুর বুকে এঁকে গেছেন সদাচারের পদরেখা। যা প্রতিটি প্রাণসঞ্চলিত মানবের জন্য আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়েছে। হয়েছে পরলোক যাত্রার অসীম পাথেয়। আঘাতে আঘাতে লহুলাহান হয়েও কল্যাণের দুয়া করেছেন। কেঁদেছেন “উম্মাতি উম্মাতি” করে।
একদা এক বেদুইনের অকস্মাৎ অবোধ আচরণে তিনি শারীরিক ব্যথা পেলেন। চাদর ধরে পেছন থেকে টেনে ধরায় ঘাড়ের দিকে সামান্য চিড়ে গেল। খানিকটু কেটেও গেল যেনবা। পেছন ফিরে তবুও সেই স্মিত হাসি, সহাস্যমুখ, চিরচেনা দেহাবয়ব। শরীরে ক্ষতের খুন তাজা রেখে আঘাতদাতার প্রতি প্রাণবন্ত-সজীব ও হাসিমাখা চেহারায় আত্মপ্রকাশের অপরূপ মহিমার অনন্য প্রসাদগুণসমৃদ্ধ ছিলেন তিনি।
ছিলেন সৃষ্টির প্রতি পরম দয়ার্দ্র। তাঁর মমতায় পশুপাখিও নির্ভার ও নিরাপদ বোধ করত। সংকটাপন্ন মানুষ যেমন তাঁর দারস্থ হতো, তেমনই পশুপাখিও নিজেদের অঙ্গভঙ্গিতে বোঝাত তাদের প্রতি অন্যায়-উৎপীড়ন ও অসহায়ত্বের বেদনা। কখনো হরিণ, কখনো উট কিংবা কখনো পাখির কিচিরমিচিরে বুঝে নিতেন তারা ভালো নেই। বুঝে নিতেন এই ভালো না থাকার কারণ। সকলের প্রতিই তাঁর হৃদয়ের উষ্ণ ভালোবাসা শতধারায় বর্ষিত হতো।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, তাঁর ঘরে মাসের পরে মাস চুলায় আগুন জ্বলতো না। কখনো দিনে তিনবেলা লাগাতার খাবার জোটেনি। অথচ দানশীলতার ক্ষেত্রে ছিলেন সবার উর্ধ্বে। ঘরে ক্ষুধার অন্ন বলতে কিছুই নেই, তবুও খালি হাতে কখনো ফেরেনি আগন্তুক। আরব্য দানশীলতা ও মেহমানদারি সম্পর্কে অনেক শুনেছি, অথচ তাঁর দানের সমপর্যায় ছিল না কেউ।
অথচ ছিল না শীতবস্ত্র। অভাবের কষাঘাতে পরিবার ছিল জর্জরিত। ভালোবেসে পরমাদরে জনৈকা একটি শাল বুনে আনলেন। ভক্তিভরে সাদরে গ্রহণ করলেন তিনি। গায়ে জড়িয়ে বসে রইলেন। অমনই একজন দরিদ্র সাহাবী বলা নেই কওয়া নেই শালে হাত দিয়ে–কাপড়টা কেমন– খানিকটা পরখ করতে চাইলেন বোধহয়। বললেন, “আমাকে এটি দিয়ে দিন, ইয়া রাসূলাল্লাহ!” সেই চিরচেনা অম্লমধুর হাসি। বৈঠক শেষে উঠে গিয়ে ভাঁজ করে এনে সঁপে দিলেন সেই সাহাবীর হাতে। নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে অপরের মুখে হাসি ফোটানোর সবকদাতা ছিলেন তিনি।
নির্ধারিত সময়ের আগেই পাওনাদারের অসহিষ্ণুতা ও জোরালো বাক্যবাণের সামনে দাঁড়িয়েও সৌম্য-শান্ত-কোমলতার পরিচয় দিয়ে গেছেন তিনি। ভক্ত-অনুরক্ত ও অধৈর্য সহচরবৃন্দের মারমুখি রক্তচক্ষু নিয়ন্ত্রণ করতেন৷ পরাস্ত করতেন তাদের প্রতিশোধের জোশালো স্পৃহা। যেন মানবজগত বহির্ভূত কোন কণ্ঠস্বর ভেসে এসে আঁছড়ে পড়ছে তাঁর কণ্ঠ হতে। সেই মুখনিঃসৃত বাণী এমন কোমল শোনাত যে, বন্ধুরা ভাবতেন, এমনও কি মানুষ হয়? এ মহান সহিষ্ণুতার সাথে পৃথিবীবাসি যে পরিচিত নয়।
জগতের অসীম মহারণ্যে সর্বাংশে সুন্দর ছিলেন তিনি। তিনি যে আমাদের পেয়ারা নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পৃথিবীর সর্বাধিক প্রশংসিত ও আকাঙ্ক্ষিত মহাপুরুষ। তাঁর পায়ের ধূলিকণার প্রতিও ঈর্ষা করা সাজে। সৃষ্টির প্রতি তিনি যেমন ছিলেন নিবেদিত প্রাণ, সৃষ্টির ভালোবাসাও তাঁর প্রতি বর্ষিত হতো শ্রাবণের অঝোরধারা পরিমাণে। এ ধারাবর্ষণ অব্যাহত থাকবে মহাকালব্যাপী।
তাই তো তাঁর ভালোবাসার ফুলকে বাঁচাবো বলে আমরা যুগযুগান্তরের যুদ্ধ করি। তাঁর পদাঙ্কানুসরণে আমাদের নাজাত কামনা করি! সৃষ্টি ও স্রষ্টা- উভয়ের সম্মিলিত দরূদ বর্ষিত হোক সেই প্রশংসিতের প্রতি। মহাকালের কণ্ঠে অণুরণিত হোক-
বালাগাল উলা বিকামালিহী, কাশাফাদ্দুজা বিজামালিহী;
হাসুনাত জামিঊ খিসালিহী, সাল্লূ আলাইহি ওয়াআলিহী!