বন্যা সংশ্লিষ্ট জরুরি মাসায়েল : যা আপনাকে জানতে হবে

হুসাইন আহমাদ:

মুসলমানের জন্য দুনিয়াটা হল পরীক্ষাগৃহ। তার প্রতিটি কর্মের ওপর এখানে ভালো-মন্দের নাম্বার বসানো হয়। দুনিয়ার পরীক্ষা যখন কঠিন হয়, আল্লাহর তরফ থেকে অতিরিক্ত পুরস্কারও তখন বরাদ্দ থাকে। বন্যা ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ মুসলমানদের জন্য এরকমই একটা কঠিন পরীক্ষা। আল্লাহ দেখেন, বান্দাদের মধ্যে কে ধৈর্যশীল! কে তাকে ডাকে, তাঁর কাছে আশ্রয় চায়! সেই বিপদের দিনেও কে তাঁর বিধান পালনে যত্নবান হয়!
ইসলামের চিরায়ত নিয়ম হল, কারোর দুনিয়া যখন সংকীর্ণ হয়, ইসলামের বিধান তার জন্য প্রশস্ত হয়ে যায়। আযিমতের হুকুম তখন রুখসতে নেমে আসে। বস্তুত ইসলাম হল একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এখানে একজন মুসলমানের জীবনের সকল মুহূর্ত ও ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রিত হয় ইসলামের বিধান দ্বারা। ফলে একজন সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থার মুসলমান যেরূপ ফরযসমূহ পূর্ণাঙ্গরূপে পালনে নির্দেশিত, সেরূপ অসুস্থ-অপারগকে ছাড় প্রদানও ইসলামের বিধিভূক্ত। সুতরাং স্বাভাবিক অবস্থার ইবাদত পালনে যেমন সুনির্দিষ্ট নিয়ম-পদ্ধতি রয়েছে তেমনি সংকটকালীন ইবাদত পালনেও রয়েছে শরিয়তের নির্দিষ্ট কিছু দিকনির্দেশনা। আজকের এই লেখায় আমরা আটটি পয়েন্টে সেই দিকনির্দেশনাগুলো আলোচনায় আনার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

বন্যার পানি ও তা দিয়ে পবিত্রতা অর্জনের বিধান

ক. প্রাকৃতিক বন্যা সাধারণত বৃষ্টি ও নদীর পানি থেকে হয়ে থাকে। এই দুই উৎসের পানি পবিত্র তাই বন্যার পানিও পবিত্র। তাই এ পানি থেকে নাপাকি দূরীকরণ ও পবিত্রতা অর্জন করা জায়েয হবে। (বাদায়েউস সানায়ে– ১/১৫)

খ. তবে যদি পানির সাথে মাটি বা অন্য কোনো পবিত্র বস্তু মিশ্রিত হয়ে পানিকে অতিরিক্ত ঘোলা করে দেয়। যার দরুণ স্বাদ, রং, ঘ্রাণ– পানির এই তিনটি গুণের কোনো একটিতে পরিবর্তন আসে, অথবা পানির স্বাভাবিক তরলতা ও প্রবহমানতা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সে পানি খোদ পাক থাকবে বটে, কিন্তু তা দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা জায়েয হবে না। (হিন্দিয়া–১/২১)
আর যদি নাপাক বস্তু মিশ্রিত হয়ে পানির গুণ বা স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দেয় তাহলে তা নাপাক হয়ে যাবে।

গ. বন্যার পানি যেহেতু বিভিন্ন রোগ-জীবাণু বহন করে থাকে, যা স্বাস্থ্যে জন্য ক্ষতিকর, তাই একেবারে নিরুপায় অবস্থা ছাড়া বন্যার পানি পান করা জায়েয হবে না। কেননা শরিয়তে অন্যের ক্ষতি সাধন যেমন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে, তেমনি ‘হাতে ধরে’ নিজের ক্ষতি করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ঘ. যখন বন্যার পানি পবিত্রতা অর্জন করার অনুপযোগী হয়ে যাবে এবং পবিত্রতা অর্জনের জন্য অন্য কোনো পবিত্র পানির ব্যবস্থাও না হবে, বন্যাগ্রস্থ ব্যক্তির জন্য তখন তায়াম্মুমের মাসয়ালা চলে আসবে। অর্থাৎ সে তখন মাটি বা মাটি জাতীয় কোন বস্তু যেমন, পাথর, চুনা বা দেয়াল ইত্যাদি থেকে তায়াম্মুম করে নামায আদায় করে নিবে।

ঙ. যদি তায়াম্মুম করার মতোও কিছু না থাকে তাহলে সে ব্যক্তি ফাকিদুত তহুরাইন তথা পবিত্রতা অর্জনের দুটি উপকরণ– পানি ও মাটি– উভয়টি না-পাওয়া-ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। তখন সে পবিত্রতা অর্জন ছাড়াই নামাযি ব্যক্তির সাদৃশ্য গ্রহণ করে নামায আদায় করবে এবং পরবর্তীতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে সেই নামায কাযা আদায় করে নিবে।

চ. যদি বন্যার পানি নাপাক হয় এবং তাতে কেউ আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে বের হওয়ার কোন উপায়ও না থাকে। তাহলে নাপাকির মধ্যেই সে নামায পড়ে নিবে। পরবর্তীতে তা আর কাযা করতে হবে না। (তাতারখানিয়া–২/৬৭৮)

নামাযের বিধান

স্বাভাবিক অবস্থায় নামায আদায়ের যে পদ্ধতি শরিয়তে বর্ণিত হয়েছে, অস্বাভাবিক ও বিশেষ অবস্থার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। কুরআনে ঘোষণা এসেছে

لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۚ
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সাধ্যের বাইরে কোনো হুকুম বান্দার ওপর আরোপ করেন না। (বাকারা–২৮৫)
কুরআানের অন্যত্র এসেছে,

الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ

অর্থাৎ যারা দাঁড়ানো, বসা এবং শোয়া অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। (আলে ইমরান–১৯১)
ইমাম দাহহাক বলেন, এই আয়াতে অসুস্থ-অপারগ ব্যক্তিদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যে, তারা নিজেদের শক্তি-সামর্থ অনুযায়ী [যেভাবে পারে] ইবাদত পালন করবে। (আল মুহিতুল বুরহানি–৩/২৬)

হাদিস শরিফেও বিশেষ অবস্থায় যেমন, অসুস্থাবস্থায়, নৌকায় আরোহনকালের নামায আদায়কেও বান্দার সাধ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং কোনো ব্যক্তি যখন বন্যার পানিতে আকটা পড়ে যায় এবং স্বাভাবিক পদ্ধতিতে নামায আদায় করতে না পারে তখন তার নামায আদায়ের পদ্ধতিতে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ তার নামাযে ছাড় অনুমোদিত হয়। যেমন :

ক. বন্যার্ত ব্যক্তি যদি পানিতে আটকা পড়ে যায় এবং তার কাছে নৌকা থাকে তো নামায নৌকাতে পড়ে নিবে। আর যদি নৌকা না থাকে তাহলে সে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার আশায় অপেক্ষা করবে। অতঃপর ওয়াক্ত শেষ হওয়ার আগ দিয়ে পানিতেই নামায পড়ে নিবে। এক্ষেত্রে পানিতে দাঁড়িয়ে যেভাবে সম্ভব সেভাবেই নামায আদায় করবে। যেমন,
→ যদি পানি অল্প হয় এবং রুকু করতে সক্ষম হয় তাহলে রুকু সহকারে নামায আদায় করবে। আর সেজদা ইশারায় করে নিবে।
→ আর যদি রুকু করতেও সক্ষম না হয় তাহলে পানিতে দাঁড়িয়ে নামায আদায়কালে রুকু-সেজদা উভয়টা ইশারায় করবে।
→ তবে যদি সাঁতার-পানি হয় তাহলে সে তখন নামায আদায় করবে না। বরং পরবর্তীতে কাযা আদায় করে নিবে। (হাশিয়াতুত তাহতাবি আলা মারাকিয়িল ফালাহ–৪০৭)

খ. পানিতে আটকে-পড়া ব্যক্তির ওপর জুমার নামায ওয়াজিব হবে না। কেননা জুমার নামায আদায়ের জন্য জামাত শর্ত।

রোযার বিধান

আল্লাহ তায়ালা রমযানের রোযা ফরজ করার পরই অসুস্থ ও মুসাফিরকে এই বিধানের আবশ্যিকতা থেকে মুক্ত ঘোষণা করেছেন এবং ছুটে যাওয়া রোযাগুলো পরবর্তীতে কাযা আদায় করে নেওয়ার সুযোগ প্রদান করেছেন। আল্লাহ বলেন, فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍۢ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَۚ
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ বা সফরে থাকে তার জন্য অন্যদিনসমূহ হতে গণনা করবে (রোযাগুলো অন্যদিন আদায় করে নিবে।) (বাকারা–১৮৪)
ফুকাহায়ে কেরাম এই আয়াত থেকে মুশাক্কাত তথা ‘মানবশক্তির বাইরে অসহনীয় কষ্ট’কে রোযা না-রাখার ইল্লত তথা কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেমন প্রাণনাশী ক্ষুৎপিপাসা বা ক্লান্তি ইত্যাদি রোযার না-রাখা জায়েয হওয়ার ইল্লত বা কারণ। (বাদায়েউস সানায়ে–২/৯৭)
সুতরাং বন্যাগ্রস্থ ব্যক্তির রোযা রাখার দ্বারা যদি তার জীবন বিপণ্নের সম্মুখীন হয়, তাহলে তার জন্য রমযানের রোযা না-রাখার অনুমতি আছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রাখতে না-পারা রোযাগুলোর কাযা আদায় করে নিতে হবে।

যাকাতের বিধান

এখানে যাকাতের দুটি দিক আলোচ্য।

এক. বন্যার্ত ব্যক্তিকে যাকাতের টাকায় ত্রাণ দেয়া 

শরিয়ত কর্তৃক যাকাত আদায়ের খাত নির্দিষ্ট। যাকাত আদায়ের খাত ব্যতিত অন্য কোথাও অর্থ দিলে যাকাত আদায় হবে না। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلْفُقَرَآءِ وَٱلْمَسَٰكِينِ وَٱلْعَٰمِلِينَ عَلَيْهَا وَٱلْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِى ٱلرِّقَابِ وَٱلْغَٰرِمِينَ وَفِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبْنِ ٱلسَّبِيلِ ۖ فَرِيضَةً مِّنَ ٱللَّهِ ۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা যাকাতকে আট শ্রেণির মানুষের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। যথা :
১. দরিদ্র
২. নিঃস্ব
৩. যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারী
৪. যাদের মন রক্ষা করতে অভিপ্রায় হয় (অমুসলিম বা নবমুসলিম)
৫. দাস মুক্ত করার কাজে
৬. ঋণগ্রস্ত
৭. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী
৮. ও (সম্পদহীন) মুসাফিরকে। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান। তিনি মহাজ্ঞানী ও করুণাময়। (সুরা তাওবা–৬০)
অর্থাৎ এই আয়াতে আট প্রকার ব্যক্তিকে যাকাত আদায়ের খাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী ৪র্থ প্রকারের অমুসলিমদের যাকাত প্রদানের বৈধতাটা রহিত হয়ে গেছে। এখন স্পষ্ট যে, একজন ব্যক্তি শুধু বন্যার্ত হওয়ার কারণে যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হবেন না। বরং তাকে উল্লিখিত সাত প্রকারের কোনো এক প্রকারের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। সুতরাং বন্যার্ত ব্যক্তিকে যাকাতের টাকায় ত্রাণ দেওয়ার হুকুম নিম্নরূপ :

ক. বন্যার্ত ব্যক্তি যদি দরিদ্র বা ঋণগ্রস্ত হয় তাহলে তার জন্য যাকাতের টাকার ত্রাণ গ্রহণ করা জায়েয হবে এবং ত্রাণদাতার যাকাতও আদায় হয়ে যাবে।

খ. সম্পদ ছিল কিন্তু বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এমন ব্যক্তিকে দিলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

গ. বন্যার্ত ব্যক্তি সম্পদশালী কিন্তু তার সম্পদ অনকে দূরে হওয়ায় এই দুর্যোগের সময় তা কোনো কাজে আসছে না। এমন ব্যক্তি ইবনুস সাবিল তথা সম্পদহীন মুসাফিরের হুকুমে। তাকে দান করলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।

ঘ. কোনো অমুসলিমকে যাকাতের টাকায় ত্রাণ দিলে যাকাত আদায় হবে না। কেননা আয়াতে উল্লেখিত ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য অমুসলিমদের যাকাত দেওয়ার যে খাতটা বর্ণিত আছে তা রহিত হয়ে গেছে। সুতরাং অমুসলিমদের ত্রাণ দিলে সাধারণ দান-সদকার টাকা থেকে দিতে হবে। (শামি–৩/৩৩৮)

দুই. বন্যার্ত ব্যক্তির যাকাতদানের বিধান

ক. কোনো ব্যক্তির সম্পদ নেসাব পরিমাণ হওয়ার পূর্বে কিংবা বৎসর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই যদি বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তার ওপর যাকাত আসবে না।

খ. যদি নেসাব ও বৎসর পূর্ণ হওয়ার পর ধ্বংস হয়ে যায় তাহলেও তার যাকাতদানের আবশ্যিকতা রহিত হয়ে যাবে। (ইমদাদুল আহকাম– ২/১৩)

গ. যদি ধ্বংস হওয়া সম্পদ ছাড়াও বন্যার্ত ব্যক্তির মালিকানায় দূরবর্তী কোথাও নিরাপদ সম্পদ থাকে তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে যাকাত দিতে হবে না। কিন্তু পরবর্তীতে নিরাপদ সম্পদ থেকে ধ্বংস হওয়া সম্পদসহ সমুদয় সম্পদের হিসেবে যাকাত দিতে হবে।

হজের বিধান

হজ ওয়াজিব হওয়ার জন্য সম্পদের পাশাপাশি যাতায়াতের রাস্তাও নিরাপদ হওয়া শর্ত। বন্যার কারণে যদি রাস্তা বন্ধ বা অনিরাপদ হয়ে যায় তখন হজের বিধান নিম্নরূপ :

ক. কারো ওপর হজ ফরয হওয়ার পর যদি নিজ অঞ্চলে বন্যা হয় এবং সেখান থেকে বের হয়ে হজে যেতে সক্ষম না হয় তাহলে সে বছরের জন্য সে ব্যক্তি হজ আদায়ের আবশ্যিকতা থেকে মুক্তি পাবে।

খ. বন্যা যদি হজে যাওয়ার রাস্তায় হয়। যেমন: শহরে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে বিমানবন্দর ডুবে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় তবুও সে ব্যক্তি সে বছরের জন্য হজের আবশ্যকতা থেকে মুক্তি পাবে।

গ. হারাম শরিফের ভেতর যদি এমন বন্যা হয় যে, হজের কোনো বিধানই পালন করা সম্ভব হবে না। তবুও সে বছরের মতো তার জন্য হজ আদায় মওকুফ হয়ে যাবে। তবে উল্লিখিত তিনো সুরতে আগামীতে হজ কাযা আদায় করতে হবে। (হিন্দিয়া–১/২১৮)

ঘ. হারাম শরিফে পৌঁছার পর যদি কেউ বন্যার সম্মুখীন হয়। অর্থাৎ হারাম শরিফে যদি বন্যা হয়। যার কারণে হজের বিধি-বিধান পালন করতে না পারে। তাহলে সে বন্যা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যদি এরমধ্যে হজের সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে দমে ইহসার তথা কোনো একটা জন্তু জবাই দিয়ে হালাল হয়ে যাবে এবং আগামীতে এই হজের কাযা করে নিবে। (শামি–২/৩৯৯)

দাফনের বিধান

যদি বন্যাদুর্গত অঞ্চলে কেউ মারা যায় এবং তাকে কবর দেওয়ার মতো কোনো শুকনা জায়গা না থাকে। এমন কোনো ব্যবস্থাও যদি না থাকে যার মাধ্যমে লাশ শুকনা অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। এবং বন্যার পানি চলে যাওয়ার অপেক্ষা করলেও লাশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা হয়। তাহলে এমতাবস্থায় জানাযা ও কাফন সম্পন্ন করে মৃত ব্যক্তির লাশকে ভাসিয়ে দিতে হবে। ইমাম আহমদ ইনবে হাম্বল রহ. বলেন, লাশের সাথে ভারী কিছু বেঁধে স্রোতস্বিনী কোনো স্থানে ডুবিয়ে দিবে। (হাশিয়াতুত তাহতাবি আলা মারাকিয়িল ফালাহ–৬১৩, শামি–৩/১৬৬)

৭. বন্যার্ত ব্যক্তির বাঁচা-মরার প্রশ্নে অন্যের সম্পদে হস্তক্ষেপ করার বিধান

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে পাকে বলেন,

إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ ٱلْمَيْتَةَ وَٱلدَّمَ وَلَحْمَ ٱلْخِنزِيرِ وَمَآ أُهِلَّ بِهِۦ لِغَيْرِ ٱللَّهِ ۖ فَمَنِ ٱضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍۢ وَلَا عَادٍۢ فَلَآ إِثْمَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি হারাম ভক্ষণ করতে বাধ্য হয় এবং হারাম ভক্ষণের প্রতি যদি সে আগ্রহী ও এতে সীমালঙ্ঘনকারী না হয় তবে তার গুনাহ নাই। নিশ্চয় আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়। (বাকারা–১৭৩)

কুরআনের এই আয়াত থেকে ফুকাহায়ে কেরাম দুটি মূলনীতি উৎসারণ করেছেন।
একটি হল, الضرورة تبيح المحظورات অর্থাৎ জরুরত তথা অতীব প্রয়োজন নিষিদ্ধ বিষয়কে বৈধ করে দেয়। যেমন উল্লিখিত আয়াতে জীবনরক্ষার স্বার্থে হারাম ভক্ষণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তেমনিভাবে কোন বন্যার্ত ব্যক্তি বা তার পরিবার যখন জীবন-মরণ সমস্যার সম্মুখীন হয়। যেমন সে বা তার পরিবার বন্যার কারণে কোনো বিপজ্জনক জায়গায় পতিত হয়েছে। তাদের উদ্ধার করা না হলে নিশ্চিত মারা যাবে। এমতাবস্থায় তার প্রতিবেশী বা অন্য কারো নিকট নৌকা আছে কিন্তু সে নৌকা দিতে রাজি না। অথবা রাজি কিন্তু ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে এতবেশী দাবী করেছে যে, তারপক্ষে আদায় করা সম্ভব না। এহেন মুহূর্তে সে ব্যক্তি শক্তি প্রয়োগ করে জোরপূর্বক মালিক থেকে নৌকা নিয়ে বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করবে। তবে শর্ত হল, এই নৌকার ওপর যেন নৌকার মালিকের বাঁচা-মরা সম্পৃক্ত না থাকে। কারণ অন্যের জীবন বিপদের মুখে ফেলে নিজের জীবন বাঁচানো জায়েয নাই।
দ্বিতীয় মূলনীতিটি হল, الضرورة تقدر بقدر ضرورتها অর্থাৎ জোরপূর্বক অন্যের জিনিস গ্রহণের অনুমতির এই বিধান যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এরচেয়ে বেশি সীমালঙ্ঘন ও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং নৌকা নেওয়ার পর উদ্ধারকার্য সম্পণ্ন করে ন্যায্য ভাড়া সহ নৌকা ফেরত দিতে হবে। (আল আশবাহ ওয়ান নাযারের–২৫১–২৫২)

 উপসংহার

প্রাকৃতিক দূর্যোগ একটি চিরাচরিত নিয়মের অংশ। একে সঙ্গে করেই আমাদের চলতে হয়। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরালে আমরা দেখি, হযরত নুহ আ. এর যুগ থেকে অধ্যাবধি পৃথিবীতে অনেক বড় বড় দূর্যোগ-বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। তাই এই বিপর্যয়ের সময় আমাদের ভেঙে পড়লে হবে না, মনোবল শক্ত রাখতে হবে। বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করতে হবে। কেননা রাসুল সা. দূর্যোগকালে সবচেয়ে বেশি তাওবা-ইসতেগফার করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দিতেন। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, যেন তাঁর উম্মতকে কোনো প্রাকৃতিক আযাব দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া না হয়। কেননা হযরত নুহ আ. এর উম্মতকে বন্যা দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন, যখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতো এবং ঝড়ো বাতাস বইত—তখন রাসুল সা. এর চেহারায় চিন্তার রেখা ফুটে উঠত। এই অবস্থা দেখে তিনি এদিক-সেদিক পায়চারি করতে থাকতেন এবং এ দোয়া পড়তেন—

اللهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَهَا، وَخَيْرَ مَا فِيهَا، وَخَيْرَ مَا أُرْسِلَتْ بِهِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا، وَشَرِّ مَا فِيهَا، وَشَرِّ مَا أُرْسِلَتْ بِهِ
হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে এ বৃষ্টির কল্যাণগুলো কামনা করছি, এই বৃষ্টিতে যেসব কল্যাণ রয়েছে সেগুলো কামনা করছি এবং এই বৃষ্টির মাধ্যমে প্রেরিত কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আর আর এ বৃষ্টি ও বৃষ্টির মাধ্যমে প্রেরিত সব রকম অকল্যাণ ও বিপদাপদ থেকে পরিত্রাণ চাই।’
(বুখারি, হাদিস : ৩২০৬; মুসলিম, হাদিস : ৮৯৯)

বুখারি শরিফে হযরত আনাস (রা.) বর্ণনায় এসেছে, মদিনায় একবার অতিবৃষ্টির ঘটনা ঘটে৷ টানা বৃষ্টিতে পথ-ঘাট ভেসে যায়। মানুষের সম্পদ নষ্ট হতে থাকে। রাসুল সা. জুমার খুতবাদান করছিলেন। এমন সময় এক সাহাবি এসে এহেন দূর্যোগ পরিস্থিতির অভিযোগ জানালেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই হাত উঁচিয়ে দোয়া করলেন—

اللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا ولَا عَلَيْنَا، اللَّهُمَّ علَى الآكَامِ والظِّرَابِ، وبُطُونِ الأوْدِيَةِ، ومَنَابِتِ الشَّجَرِ

অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদের আশপাশে বৃষ্টি দিন, আমাদের ওপরে নয়। হে আল্লাহ! পাহাড়-টিলা, খাল-নালা এবং গাছ-উদ্ভিদ গজানোর স্থানগুলোতে বৃষ্টি দিন।

আমাদের কাজ হল বন্যার সময় হতাশ না হয়ে উল্লিখিত দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়তে হবে। আল্লাহ চাহে তো তাঁর হাবিবের সুন্নতের অনুসরণের উসিলায় দূর্যোগ থেকে খুব দ্রুত মুক্তি দান করবেন।

লক্ষণীয় হল, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের বন্যা ও খরার বাস্তবতা যতটা না প্রাকৃতিক তারচেয়ে ঢের বাস্তবতা হল ‘প্রতিবেশী’র অন্যায় স্বেচ্ছাচারিতা। উসুলে ফিকহের মূলনীতি হল, الضرر يزال অর্থাৎ ক্ষতি দূরীকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আক্রান্ত হওয়ার আগেই, অথবা পরে। বরং আগ থেকেই দূর্যোগ মোকাবেলায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা শরিয়তে কাম্য। তাই কৃত্রিমভাবে বন্যা সৃষ্টির কারণগুলো চিহ্নিত করে সরকারকে তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করতে হবে সরকারকে। এটা সরকারের মানবিক ও নৈতিক দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। সামর্থ্যবান জনগণও এ দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে না।

আগের সংবাদ১৭টি ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে বিএসটিআই
পরবর্তি সংবাদপ্রচণ্ড দাবদাহে যুক্তরাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি