স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডাকে কওমি মাদরাসা বিষয়ক বৈঠক : কী ভাবছেন বোর্ড সংশ্লিষ্টরা?

রাকিবুল হাসান নাঈম :

আগামী ১০ আগস্ট কওমি মাদরাসা বিষয়ক একটি বৈঠক ডেকেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্র ণালয়। বৈঠকে কওমি মাদরাসার সমন্বিত বোর্ড হাইয়াতুল উলয়ার অধীন ছয় বোর্ডের সভাপতিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারা বৈঠকে যাবেন কিনা, সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। তবে এই বৈঠক যে অনাহুত, অপ্রত্যাশিত, তা এই ছয় বোর্ডের মুরুব্বিদের কথায় স্পষ্ট।

বৈঠকের মোটিভ কী?

জানা গেছে, ২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করে একটি চিঠি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী। বৈঠক ডাকার পেছনে এই চিঠি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বৈঠকের মোটিভ হিসেবে এই আবেদনের কথা সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।

উপ সচিব মো. শামীম হাসান স্বাক্ষরিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, গত বছর (২০২১) ২৬, ২৭, ২৮ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে সংঘটিত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়। এ বিষয় অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে দেওয়া সুপারিশের আলোকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং চলতি বছর গত ২৫ জুন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমিরের পাঠানো চিঠির সুপারিশের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে। হেফাজতের আমিরের চিঠিতে বাংলাদেশ কওমী ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মান উন্নয়নকল্পে আটটি সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে আগামী ১০ আগস্ট (বুধবার) সকাল ১১টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সভাটি অনুষ্ঠিত হবে।’

সভায় যোগ দিতে শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রী, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, এনএসআই মহাপরিচালক, ডিজিএফআই মহাপরিচালককে অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি বেফাক, কওমি মাদ্রাসা বোর্ড গহরডাঙ্গা, ইত্তেহাদুল মাদারিস, আযাদ দ্বীনি বোর্ড, তানযীমুল মাদারিস, জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও মহাসচিবকেও বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

কী আছে চিঠিতে

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেয়া ‘কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মান উন্নয়নকল্পে সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ’ শীর্ষক চিঠিতে মিজানুর রহমান আটটি সুপারিশ করেন।

সুপারিশগুলো হচ্ছে:

১. কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষার মান উন্নয়নে আপনি (প্রধানমন্ত্রী) দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়ে সনদের ব্যবস্থা করেছেন এবং এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য জাতি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। ওই আইনে কওমি শিক্ষার সূচনা অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরের ভিত্তি উল্লেখ নেই, সাধারণ শিক্ষায় যেমনটি আছে। কওমি শিক্ষা আইনে এই বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাটি ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমতাবস্থায় ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীন ‘কওমি মাদরাসা সমূহের দাওরায়ে হাদিসের (তাকর্মীল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিস ও আরবি) সমমান প্রদান আইন, ২০১৮’এর ২(১) ধারায় ‘কওমি মাদরাসা’ এর সংজ্ঞায় বর্ণিত ‘কওমি মাদরাসা’ অর্থ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আত ও দারুল উলূম দেওবন্দের আদর্শ, মুলনীতি ও মত-পথের অনুসরণে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তার উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ইলমে ওহির শিক্ষাকেন্দ্র;’ উক্ত ধারার সঙ্গে ‘যেখানে মক্তব, নাজেরা, হেফজ থেকে শুরু করিয়া দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত এবং তৎপর ইফতা, উলুমুল হাদিস, তাফসিরসহ উচ্চতর শিক্ষা দেওয়া হয়’ সংযুক্ত করা আবশ্যক।

২. কওমি ধারার শিক্ষা একটি বিশেষায়িত শিক্ষা ব্যবস্থা। উহার শিক্ষক ও শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রতিটি শিক্ষকের বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা।জাতীয়ভাবে বা ব্যক্তি উদ্যোগে ‘কওমি মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করা খুবই প্রয়োজন।

৩. যেহেতু কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের আর্থিক সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে, সেকারণে মাদরাসার সকল প্রকার দান আয়কর মুক্ত থাকা দরকার। এই বিষয়ে পরিপত্র জারি করলে দাতারা উৎসাহের সঙ্গে কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দান করতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করবেন।

৪. মাদ্রাসার নিজস্ব আয় থেকে শিক্ষক কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন, স্বল্প আয়ের শিক্ষকদের মাসিক বেতন নিয়মিত পরিশোধ করা, মেধাবি, এতিম, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা।

৫. কোনও সরকার প্রধানের উদ্যোগে একই সঙ্গে ৪৬০টি উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ একটি বিশ্ব রেকর্ড বটে। উক্ত মসজিদ সমূহে ইমাম ও খতিব নিয়োগের ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসা থেকে পাস করা মেধাবি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদার অনুসারিদের ইমাম খতিব নিয়োগ প্রদানে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং নিয়োগ বোর্ডে স্থানীয় কওমি মাদ্রাসা থেকে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা যেন ভিন্ন মতাদর্শীরা নিয়োগ পেতে না পারে। তাহলে সরকারের প্রদত্ত স্বীকৃতি বাস্তবে আরও প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।

৬. কওমি শিক্ষাঙ্গন এবং সংশ্লিষ্ট ছাত্র শিক্ষক, কর্মচারীদের সকল প্রকার প্রচলিত রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

৭. সকল কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেফাক ও হাইয়াতুল উলইয়া-র আওতাভুক্ত করে তার নীতিমালার আলোকে পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা; যাতে ছাত্রদের পড়ালেখার মান নিশ্চিত করা যায়।

৮. মুহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী মনে করেন, তার দাবি বাস্তবায়িত হলে এবং প্রতিটি কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখলে ব্যক্তি ও জাতি গঠনে কওমি মাদরাসাগুলো অনেক বেশি অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, মাদক নির্মূল ও সামাজিক অবক্ষয় রোধে তৃণমূল পর্যায়ে মাদরাসাগুলোর উলামায়ে কেরামের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।

জানতো না কওমি শিক্ষাবোর্ড

তার সব দাবি কওমি মাদরাসার শিক্ষা উন্নয়ন কেন্দ্রীক হলেও এই চিঠির ব্যাপারে অবগত ছিলেন না কওমি মাদরাসার কোনো শিক্ষাবোর্ডই। প্রতিবেদকের সঙ্গে বেশ কয়েকজন মুরুব্বির কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, এ চিঠির সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ নেই।

কোন বোর্ডকে বিষয়টি জানানোর প্রয়োজনও মনে করেননি খোদ সুপারিশকারী। কওমি শিক্ষাবোর্ডের সঙ্গে কথা বলেই এই সুপারিশ করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘এটা একান্তই ব্যক্তিগত সুপারিশবববববব। কোনো বোর্ডের আমি সদস্যও না, কারও সঙ্গে আমার কথাও হয়নি। এখন তারা যদি প্রয়োজন মনে করে, আমার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবেন।’

তবে মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রস্তাবিত বিষয়ে বৈঠক ডাকা হলেও সেই বৈঠকে তাকেই আহ্বান জানানো হয়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমন্ত্রণ জানায়নি। আমি জানি না কেন ডাকেনি। তবে বৈঠকে আমি থাকলে প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে কারও কোনও প্রশ্ন থাকলে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিতে পারতাম। আমি জানি একদিনে সমাধান আসবে না। তবে আলোচনার মাধ্যমেই একদিন সমাধান হবে।’

রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি কেন?

কওমি শিক্ষাঙ্গন এবং ছাত্র-শিক্ষক সংশ্লিষ্ট সবাইকে সকল প্রকার প্রচলিত রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করার একটা দাবি জানিয়েছেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। কেন তিনি এমন দাবি জানালেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো দেওবন্দের সিলসিলা অনুসরণ করে। দেওবন্দের সিলসিলা রক্ষা করেই সনদ দেয়া হয়েছে”। কিন্তু সে সিলসিলায় তো শিক্ষক ও ছাত্রদের রাজনীতি করার নিয়ম নেই। ছাত্ররা আসে পড়াশোনা করতে, রাজনীতি শিখতে না। তারা রাজনীতি করতে চাইলে করবে পড়াশোনা শেষ করার পর। তাই আমি এই আবেদন করেছি।’

ইসলামি রাজনীতি তাহলে কারা করবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইসলামি রাজনীতি করে কী হচ্ছে এ দেশে। যত আন্দোলন হচ্ছে, সেসব আন্দোলনে তো আমাদের ইসলামী রাজনীতিবিদরা তাদের আদর্শ ধরে রাখতে পারছে না। বিকিয়ে যাচ্ছে।’ রাজনীতি করতে হলে কওমি মাদরাসা থেকে বের হয়েই রাজনীতি করতে হবে বলেও জানান তিনি।

কী ভাবছেন বোর্ড সংশ্লিষ্টরা?

চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহ সভাপতি ও আল হাইআতুল উলয়ার সদস্য মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু ফাতেহকে বলেন, ‘চিঠির বিষয়ে জানতে পেরেছি। তবে এই চিঠির সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা আলোচনা করছি।’

জাতীয় দ্বীনি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ আলী ফাতেহকে বলেন, ‘এই চিঠির সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে যাব কিনা বৈঠকে, এখনও নিশ্চিত না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়ার প্রিন্সিপাল ও কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক ফাতেহকে বলেন, ‘যা বলার আমরা বিবৃতি দিয়ে বলব। এখন কিছু বলতে চাইনা।’

 

আগের সংবাদপ্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরে ৪৬ জনের চাকরির সুযোগ
পরবর্তি সংবাদস্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কওমি মাদরাসা বিষয়ক বৈঠকে যাচ্ছেন না আলেমরা