রাকিবুল হাসান নাইম:
বিভিন্ন দেশে জাতীয় ফিকাহ বোর্ড থাকলেও বাংলাদেশের শীর্ষ মুফতিদের সমন্বয়ে এমন কোনো ফিকাহ বোর্ড নেই। কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাক এবং হাইয়ার তত্ত্বাবধানে মুফতি বোর্ড গঠিত হলেও কাজের ময়দানে সরব থাকতে পারেনি বোর্ডগুলো। এর পেছনে কর্তৃপক্ষের অবহেলাকেই দায়ি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশে জাতীয় ফিকাহ বোর্ড কিংবা মুফতি বোর্ড প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে এখন৷ এমন বোর্ড না থাকার কারণে দেশজুড়ে ফতোয়ার ময়দানে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। যে যার মতো ফতোয়া দিচ্ছে। তাদের সামনে জাতীয় বোর্ডের সম্মিলিত কোনো ফতোয়া নেই।
বেফাকের ‘জাতীয় মুফতি বোর্ড’
মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদী রহ. যখন বেফাকের মহাসচিব ছিলেন, তখন বেফাকের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল জাতীয় মুফতি বোর্ড। বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ছিলেন কামরাঙ্গীরচর নুরিয়া মাদরাসার প্রধান মুফতি শামসুল হক। সদস্য সচিব ছিলেন মুফতি এনামুল হক। এই বোর্ডের একজন সদস্য ছিলেন জামিয়া আরাবিয়া এমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহাদ্দিস মুফতি ইমাদুদ্দিন সাহেব।
তিনি ফাতেহকে জানান, ‘প্রতি মাসেই মুফতি বোর্ডের সভা বসতো। বিভিন্ন ফতোয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হতো। মাসিক সভায় আসতেন মুফতি দিলওয়ার হোসাইন। কয়েকটি সভায় মুফতি আবদুল মালেক সাহেবও এসেছিলেন। আমাদের যাতায়াত খরচ বহন করতো বেফাক।’
জাতীয় মুফতি বোর্ড গঠন এবং পরিচালনার পেছনে বেশ শ্রম দিতেন আবদুল জব্বার জাহানাবাদী রহ.। তিনি এ ব্যাপারে বেশ তৎপর ছিলেন বলে জানান মুফতি ইমাদুদ্দিন। তার ইন্তেকালের পরই মূলত মুফতি বোর্ডের কাজ কার্যত থেমে যায়।’
বেফাকের উদ্যোগ বন্ধ হলো কেন?
বেফাকের মুফতি বোর্ড বন্ধ হবার পেছনে বেফাকের কর্তৃপক্ষকেই দায়ি করেন মুফতি ইমাদুদ্দিন। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘জাহানাবাদী সাহেব ইন্তেকালের পর মুফতি বোর্ডের মিটিং বন্ধ হয়ে যায়। এর পেছনে দায়ি কর্তৃপক্ষই। একটা আলোচনা উঠেছে, শিক্ষাবোর্ডের দায়িত্ব ফতোয়া বোর্ড পরিচালনা করা নয়। তাহলে শুধু শুধু এর পেছনে টাকা খরচ করে লাভ কি? এরপর কর্তৃপক্ষও আর আগ্রহ দেখাননি।’
বেফাক আগ্রহ না দেখালেও আপনারা আগ্রহ দেখিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা জিজ্ঞেস করেছি, তাগাদা দিয়েছি। কিন্তু বোর্ড না চাইলে ত হবে না।’
বেফাকের উদ্যোগে এখন কোনো মুফতি বোর্ড নেই বলে জানান মুফতি ফয়জুল্লাহ।
হাইয়ার মুফতি বোর্ডও অচল, কার্যক্রম বন্ধ
পরবর্তীতে হাইয়াতুল উলয়ার অধীনে ফতোয়া বিষয়ক একটি কমিটি গঠিত হয়। হাইয়াতুল উলয়ার ওই কমিটি মাওলানা আশরাফ আলী সাহেবকে আহ্বায়ক করে এবং হাইয়াতুল উলয়ার আরও বেশ কিছু সদস্য আলেম নিয়ে গঠিত। হাইয়ার বাইরে এই কমিটিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় তিন মুফতী, মুফতী দিলওয়ার হোসাইন, মুফতী মীযানুর রহমান সাঈদ এবং মুফতী আবদুল মালেক সাহেবকে রাখা হয়।
তখন বলা হয়েছিল, হাইয়ার এই ফতোয়া কমিটি বাংলাদেশে বিদ্যমান বহুল আলোচিত ধর্মীয় সমস্যাগুলোর ব্যাপারে ফতোয়া প্রদান করবে। সাদপন্থী তাবলিগিদের ব্যাপারে একটি ফতোয়ার কাজও করছে বলে জানায় উক্ত মুফতি বোর্ড। হাইয়াতুল উলয়ার কেন্দ্রীয় কোনো বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ফতোয়া প্রকাশিত হবে বলেও জানানো হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এই ফতোয়ার কাজ সম্পন্ন হয়নি বলে জানান বেফাকের সহকারী মহাসচিব এবং হাইয়ার স্থায়ী কমিটির সদস্য মুফতি নুরূল আমীন।
ফাতেহের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ‘কমিটি গঠিত হবার পর কয়েকটি মিটিং হয়েছে। সাদপন্থী তাবলিগিদের ব্যাপারে একটি ফতোয়ার কাজ শুরু হয়েছিল, শেষ হয়নি। এখন তার কার্যক্রম চলছে না।’
ফতোয়া বোর্ড না থাকায় বিশৃঙ্খলা বাড়ছে
ভারত, পাকিস্তান, আরববিশ্ব ও ইউরোপে অনেক ফিকহি বোর্ড আছে। উদাহরণত বলা যায়, যেমন, মাজমাউল ফিকহিল ইসলামি, মুসলিম ফ্যামিলি ল’(ভারত), মাজলিসুল ফিকরিল ইসলামি (পাকিস্তান) হাইআতু কিবারিল উলামা (সৌদি আরব)। বৈশ্বিকভাবে আছে মাজমাউল ফিকহিল ইসলামি আদ দুওয়ালি, রাবেতার অধীনে মাজমাউল ফিকহিল ইসলামি, হাইআতুল মুহাসাবার অধীনে আল মাজলিসুশ শারয়ী ইত্যাদি। তারা বিভিন্ন বিষয়ে সংলাপ করে বিভিন্ন বই-ম্যাগাজিন-সিদ্ধান্তনামা ইত্যাদি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা এখন পর্যন্ত অনেকটা হতাশাজনক। এখানে সম্মিলিত কোন ফতোয়াবোর্ড গড়ে উঠেনি।
ফতোয়া বোর্ড না থাকায় বিশৃঙ্খলা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন মুফতি ইমাদুদ্দিন। তিনি ফাতেহকে জানান, ‘বোর্ড না থাকায় বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। যে যেভাবে পারছে ফাতোয়া দিচ্ছে। একটা বোর্ড থাকলে, অন্তত সম্মিলিত একটা ফতোয়া সবার সামনে থাকতো। এই বোর্ড গঠন এখন সময়ের দাবি। এই বোর্ড চাইলে হাইয়া কর্তৃপক্ষ গঠন করতে পারে আরও বিস্তৃতভাবে। সেখানে চাইলে সরকারকেও যুক্ত করে বোর্ডকে জাতীয় স্বীকৃতি দিতে পারে। জাতীয় বিভিন্ন ফিকহি সমস্যা তৈরী হয়। সেগুলোর সমাধান দিবে বোর্ড।’
জাতীয় মুফতি বোর্ডের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন সবাই । কিন্তু আরসব উদ্যোগ নেয়া হলেও এই উদ্যোগটি কেউ নিচ্ছেন না। নিলেও বিভিন্ন অজুহাতে-অবহেলায় সেগুলো থাকছে কাজ থেকে দূরে। ফলে এসব বোর্ড থেকেও না থাকার সমান। কবে একটি তৎপর জাতীয় মুফতি বোর্ড তৈরী হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে।