যেমন ছিলেন ‘ইযাহুল মেশকাত’ প্রণেতা মাওলানা রফিক আহমদ

রাকিবুল হাসান নাঈম:

পরম প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া চট্টগ্রামের সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা মুহাম্মদ রফিক আহমদ। অনন্ত বীক্ষে উড়াল দিয়েছেন পেছনে ফেলে এক কর্মবহুল জীবন, অসংখ্য ছাত্র ও অনুরাগী। পটিয়া জিরি মাদরাসার প্রধান পরিচালক মাওলানা খোবাইব বিন তৈয়ব সাহেব বলেন, তার ইন্তেকালে আমাদের ইলমী অঙ্গনে যেই গভীর শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা সহজে পূর্ণ হবার নয়। তিনি ছিলেন হাদিসে রাসুলের নিবেদিত খাদেম, প্রচণ্ড মেধাবী-প্রজ্ঞাবান লেখক ও গবেষক। অত্যন্ত নম্র, ভদ্র, বিনয়ী ও যুগসচেতন উম্মাহর দরদী ব্যাক্তিত্ব।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

১৩৬৪ হিজরি মোতাবেক ১৯৪৫ ইং সনে চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও থানার অন্তর্গত মোহরা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা জামিয়া পটিয়ার প্রথম শায়খুল হাদিস আল্লামা আহমদ রহ. (ইমাম সাহেব হুজুর)। আহমদ রহ. ছিলেন আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.-এর ছাত্র। জামিয়া তা’লিমুদ্দীন ডাভিলে তিনি শাহ সাহেবের নিকট সহীহ বুখারী পড়েন। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার দাওরায়ে হাদীসের সূচনা সাল অর্থাৎ ১৯৪৬ থেকে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় পয়তাল্লিশ বছর পটিয়া মাদরাসায় বুখারী-পাঠদান করেছেন। তারই সুযোগ্য পুত্র দেশ বরেণ্য মুহাদ্দিস মাওলানা রফিক আহমদ।

মাত্র ছয় বছর বয়সে ১৯৫১ খ্রীস্টাব্দে তিনি জামিয়া পটিয়ায় ভর্তি হন। জামিয়ার জগদ্বিখ্যাত উসতাদদের নিকট তিনি প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে তেরো বছর পর্যন্ত দরসে নিযামির কিতাবসমূহ অত্যন্ত দক্ষতা ও পারদর্শিতার সাথে পাঠ করেন। ১৯৬৫ ইংরেজিতে তিনি উচ্চতর যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন ইত্যাদি জ্ঞানের কিতাবাদি সমাপ্ত করেন। ১৯৬৭ ইং সনে আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মাদারিসের অধীনে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

কর্মবহুল জীবন

তিনি ১৯৬৯ ইংরেজিতে রাউজান ইমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার মাধ্যমেই উক্ত মাদ্রাসায় জামাতে উলা আরম্ভ হয়। এই মাদ্রাসায় শিক্ষকতা চলাকালীন তিনি ১৯৭২ ইংরেজিতে এস.এস.সি পরীক্ষা দেন। ১৯৭৪ ইংরেজিতে তিনি নানুপুর উবাইদিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৮ ইংরেজিতে তিনি জ্ঞানের মাতৃক্রোড় জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় যোগদান করেন। জামিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কিতাবাদিসহ হাদিস ও তাফসিরের বিভিন্ন কিতাব তিনি পাঠদান করেন। দীর্ঘকাল ছাত্রাবাস তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সর্বশেষ বিতর্ক বিভাগ এবং তাফসির বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব করেছেন। ফলে তার বাবার মতো তিনিও প্রায় অর্ধ শতাব্দি পটিয়ায় শিক্ষকতা করেছেন।

আল্লামা রফিক আহমদ রহ. আধ্যাত্মিক জ্ঞানসাধনার লক্ষ্যে বিশ্ববরেণ্য উলামায়ে কেরাম এবং পীর-মাশায়েখের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯৮১ সালে তিনি ইমাম সাহেব হুজুর রহ.-এর কাছ থেকে এযাজতপ্রাপ্ত হন এবং বাইতুল্লাহ শরিফে তিনি আবরারুল হক সাহেব রহ.-এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন।

পটিয়া মাদরাসার অতীত এবং বর্তমান শিক্ষকদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। আরবি, উর্দু ও বাংলা মিলে তার রচিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৩৮টিরও অধিক। তার রচিত কিতাবগুলোর মধ্যে ১. ইকামাতুল মুসলিম ২. ইযাহুল মেশকাত ৩. আকরবুল ওসায়েল শরহে শামায়েল ৪. কমারাইন শরহে জালালাইন ৫. কুররাতুল আইনাইন শরহে মুয়াত্তা মালেক ও মুহাম্মদ ৬. দরসে হিদায়া ৭. এরশাদুত্তালেবিন ৮. মওদুদির তাফসির ও চিন্তাধারা ৯. নুর ও বশর ১০. আত্মার ব্যাধি ও তার প্রতিষেধক ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

শিক্ষক হিসেবে কেমন ছিলেন তিনি

আলেম লেখক মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ ফাতেহকে বলেন, রফিক সাহেব হজুরের কাছে যারা একাগ্রচিত্তে দরস নিয়েছেন কিংবা নিবিড়ভাবে তাকে পড়েছেন তারাই বলতে পারবেন তিনি কে ছিলেন। জ্ঞানের প্রতিটা শাখায় তার পাণ্ডিত্য ছিল। তবে পন্ডিতি একদম জাহির করতেন না, পছন্দও করতেন না। কুরআন, তাফসীর, হাদীস, উসুলে হাদীস, ফেকাহ, উসুলে ফেকাহ, ফাসাহাত, বালাগাত, মানতেক, ফালসাফা, ইতিহাস, সাহিত্য সব বিষয়ে ছিল তার অবাধ বিচরণ। বিশেষত বাতিল ফিরকার যাবতীয় উসুল, দলিল এবং এর সকল জবাব ছিল হযরতের নখদর্পণে। আরবী, উর্দু, ফরাসীর সাথে সাথে বাংলা-ইংরেজিতেও ছিল হযরতের পারঙ্গমতা।

মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ আরও বলেন, দরস-তাদরীসের সাথে সাথে লেখনির জগতেও তিনি ছিলেন এক সমুজ্জ্বল সেতারা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও সমাদৃত হয়েছে তার লেখা বই। দেওবন্দি ধারায় যে লেখালেখি মূল খেদমত ও অবদানের অন্তর্ভুক্ত, সে দিক থেকে তিনি একজন পরিশ্রম-সফল শীর্ষস্থানীয় আলেম এবং জামিয়া পটিয়ার ইতিহাসে গর্ব করার মতো ব্যক্তিত্ব। লেখালেখি কীভাবে শুরু করতে হয়, কীভাবে কাজ চালিয়ে নিতে হয়, কাটাকুটির নিয়ম-ব্যাকরণ কী, সম্পূর্ণ প্রস্তুত ট্রেসিংয়ের উপর কীভাবে কারেকশনের অপারেশন চালাতে হয়, আমি এসবের প্রাথমিক পাঠ পেয়েছি তার কাছেই। সেই ‍ছাত্রজীবনে, যদিও তা ছিল উর্দু ভাষায়। তার লেখালেখির অনেককিছুর সঙ্গেই আমি জড়িত, আমার মতো আরও অনেকেই। আজ যে টুকটাক কলম চালাই, তার পাশে কলম নিয়ে বসে থাকারই বদৌলতে হচ্ছে বলে ভাবতে পারি।’

মাওলানা শাহ আবদুল আজিজ ফাতেহকে বলেন, হুজুরের বিশেষ একটি গুণ ছিল, তিনি মেধাবীদের অনেক মূল্যায়ন করতেন। তিনি যেহেতু লেখালেখি করতেন, ছাত্রদেরকেও এ বিষয়ে উৎসাহ দিতেন, প্রুফ দেখাতেন। হাতে ধরে ধরে তাদের কাজ শেখাতেন। মেধাবী হলেই হুজুরের কাছে মূল্যায়ন পাওয়া যেতো। কে কোন অঞ্চলের, সেটা নিয়ে কোনো পক্ষপাত ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে আমি তার থেকে অনেক স্নেহ পেয়েছি। হুজুর শামায়েলে তিরমিজি এবং তিরমিজি সানি পড়াতেন। আমার ইবারত হুজুর খুব পছন্দ করতেন। দরসে এসেই আমাকে খুঁজতেন। ক্লাসের মধ্যে হুজুর মাঝে মাঝে রাগ করতেন বিভিন্ন বিষয়ে। কিন্তু রাগটা ধরে রাখতেন না। একটু পরই হেসে দিতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও সহজ-সরল। তার লেখার ভাষা যতটা তেজস্বী ছিল, বলার ভাষা অতটা তেজস্বী ছিল না। তিনি নামাজের কাতারে সবার আগে আগে থাকতেন। বুজুর্গদের প্রতি তার বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। ইলমি বিতর্কের ক্ষেত্রেও তিনি বুজুর্গদের সম্মানের দিকে লক্ষ্য রাখতেন। আদাবুল ইখতিলাফ বজায় রাখতেন।

মাওলানা শিহাব উদ্দীন শফী ফাতেহকে বলেন, আমার মুহতারাম বাবার সাথে হুজুরের ভালো সম্পর্ক ছিল ৷ জামিয়া পটিয়ায় আমার শিক্ষাকালে হুজুর অসুস্থ ছিলেন। কথা বলতে, চলাফেরা করতে হুজুরের খুব কষ্ট হতো ৷ তবুও নিয়মিত দরস প্রদান করতেন৷ আমার বাবা প্রায় সময় বলতেন, হুজুরের খেদমতে সময় দিবি । বেশি বেশি তার সোহবতে থাকার চেষ্টা করবি ৷ বাবার হুকুম পালন এবং হুজুরের খেদমত আর সোহবতকে নিজের সৌভাগ্য মনে করে সুযোগ পেলেই হুজুরের কাছে গিয়ে খেদমত করার সুযোগ খুঁজতাম ৷ মাঝেমধ্যে সুযোগ হলেও অনেক সময় অন্যান্য ছাত্রের কারণে খেদমতের সৌভাগ্য হতো না ৷ হুজুর আমার জালালাইন, তিরমিযী শরীফ ২য়-খণ্ড এবং শামায়েলের তিরমিযির শিক্ষক। ইফতার প্রথম বর্ষে একদিন জামিয়াতে বুখারী শরীফের খতম এলে হুজুরের ভাগের পারাগুলো ইফতা বিভাগে পাঠিয়ে দেন ৷ সহপাঠীরা হুজুরের ভাগের পারাটি আমাকে দিয়ে খতম করালেন ৷ আছরের পর হুজুর হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠালেন ৷ গিয়ে দেখি নিত্যদিনের মতো মাঠে পায়চারী করছেন ৷ তিনি আমাকে দেখে বললেন, তোকে খুঁজছি ৷ তুই নাকি আমার পারাটা খতম করেছিস? এই কথা বলেই আমাকে কিছু টাকা দিতে চাইলেন ৷ টাকা নিতে আমাকে সংকোচ করতে দেখে বললেন, তোর হক তোকে নিতে-ই হবে ৷ উপায়ান্তর না দেখে নিতেই হলো ৷

পারিবারিক জীবনে কেমন ছিলেন

কথা হয় মাওলানা মুহাম্মদ রফিক আহমদ রহ.-এর ছেলে মাওলানা রিজওয়ান রফীক জমীরাবাদীর সঙ্গে। তিনি মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বসুন্ধরার শিক্ষক এবং মাসিক আবরারের নির্বাহী সম্পাদক। ফাতেহকে তিনি বলেন, সন্তান প্রতিপালনে বাবা ছিলেন সজাগ এবং সতর্ক। আমরা ছয় ভাই এবং দুই বোন। তিনি আমাদের পড়াশোনা নিয়ে সবসময় খোঁজখবর নিতেন। এমনকি শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করতেন, আমরা দরসে ছিলাম কিনা। পড়াশোনা ঠিকমতো করছি কিনা। এক্ষেত্রে তিনি কখনও অমনোযোগী হতেন না।

তিনি বলেন, আমার দাদা ইমাম সাহেব হুজুর ছিলেন পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি খুব রুটিন মেনে চলা মানুষ ছিলেন। পরিবারে যার যার দায়িত্ব ভাগ করা থাকতো। আমরা যৌথ পরিবারেই বড় হয়েছি। দাদা তার একেকজন ছেলেকে একেক কাজে লাগিয়েছিলেন। কাউকে দিয়েছিলেন বাজার করার দায়িত্ব, কাউকে দিয়েছিলেন লেনদেনের দায়িত্ব। আমাার বাবা যেহেতু লেখালেখি করতেন, তাই দাদা তাকে পারিবারিক কোনো দায়িত্ব দেননি। তিনি লেখালেখিতেই পূর্ণ মনোযোগ দিতেন। আমি যখন দাওরা পাশ করি, তখন পরিবার নিয়ে আমার বাবা আলাদা হয়ে যান। তখন যেহেতু আমরা বড় হয়ে গেছি, বাবা সংসারের দায়িত্বগুলো অমাদের কাঁধে তুলে দেন। তিনি আমাদের ভাইদের মধ্যেও দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছিলেন। কাউকে তার বই নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব, কাউকে সংসারের বাজার-সদাই সহ অন্যান্য দায়িত্ব। তিনি বেতন পেয়ে টাকা নিজের কাছে রাখতেন না। ছেলেদের হাতে তুলে দিতেন। সংসার পরিচালনায় যা কিছু করা লাগতো, ছেলেরাই করতো। তাই বাবা তেমন লেনদেন করতেন না। আমরা এখন বলতে পারি, মৃত্যুর সময় বাবার কোনো ঋণ ছিল না।

মাওলানা রিজওয়ান রফীক জমীরাবাদী বলেন, বাবা সারাজীবন লেখালেখি করেছেন। মাথায় তার প্রচণ্ড প্রেশার পড়েছিল। জীবনের শেষদিকে এসে তিনি স্ট্রোক করেন। ডাক্তাররা বলেছিল, তার মস্তিষ্কের কোষ শুকিয়ে গেছে। এই রোগের চিকিৎসা নেই। তিনি ধীরে ধীরে মারা যাবেন। এই রোগ ধরা পড়ে তিন-চার বছর আগেই। এতদিন তাকে সাপোর্টিং অষুধ দিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। জীবনের শেষ দুতিন মাস তার কোনো জ্ঞান ছিল না। দোআ করবেন, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন। আমিন।

আগের সংবাদ৫০ মডেল মসজিদ চালু হচ্ছে সোমবার
পরবর্তি সংবাদদাওয়াত খেয়ে আ.লীগের তিন নেতা অসুস্থ, দুজনের মৃত্যু