ট্রান্সজেন্ডার হওয়া জন্মগত বিষয় নয়: এর বায়োলজিক্যাল ভিত্তি নেই

ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন:

মানুষের লিঙ্গ পরিচয়-নারী ও পুরুষ-নির্ধারণে সুস্পষ্ট জৈবিক জেনেটিক ভিত্তি আছে। ছেলেদের রয়েছে XY ক্রোমোজোম আর মেয়েদের থাকে XX ক্রোমোজোম। এখানে মূল পার্থক্য হচ্ছে Y ক্রোমোজম, আরও নির্দিষ্ট করে বললে শুধু একটি মাত্র জিন (যা SRY নামে পরিচিত) ছেলে এবং মেয়ে লিঙ্গধারী হবে কিনা তার পার্থক্য গড়ে দেয়। এজন্য এই জিনকে মাস্টার সেক্স রেগুলেটর বা ছেলে-মেয়ে হওয়ার মলিকিউলার সুইচ বলে। সুইচটি যদি সক্রিয় হয় তবে ভ্রুণটি ছেলে হবে। আর যদি সেই SRY জিন কোনো কারণে নষ্ট বা নিষ্ক্রিয় থাকে তবে ভ্রুণটি হবে মেয়ে। জেন্ডার পরিচয়ে (মনের ইচ্ছানুযায়ী যৌন পরিচয়) নির্ণয়ে এমন কোনো জেনেটিক ভিত্তি নেই; অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট কোনো জিন বা জেনেটিক মার্কার গত ২০-৩০ বছর শত চেষ্টা করেও বের করা সম্ভব হয়নি।

প্রসঙ্গত, লিঙ্গ পরিবর্তন বা sex change নিয়ে ফিশ মডেলে অনেক গবেষণা হয়েছে। এই রিসার্চ ফিল্ডে আমি পিএইচডি করেছি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিংগাপুরে। আমার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল জেব্রাফিশ (খুব পপুলার রিসার্চ মডেল) কিভাবে মেয়ে থেকে ছেলে মাছে রূপান্তরিত হয়। আমার পিএইচডি থিসিস পেপার (Molecular Analyses of Gonad Differentiation and Function in Zebrafish ) গুগল সার্চ করে পড়া যাবে। এই ফিশের মানুষের মতো সুনির্দিষ্ট সেক্স ক্রোমোজোম নেই। জন্মের এক পর্যায় পর্যন্ত (প্রথম ৩ সপ্তাহ) সব জেব্রাফিশ মেয়ে হিসেবে বড় হয় এবং পরে কিছু অপরিপক্ক মেয়ে (Juvenile Zebrafish) ফিশ ছেলেতে রূপান্তরিত হয়।

আমার কাজ ছিল মলিকিউলার লেভেলে আসলে কি ঘটে তার রহস্য উন্মোচন করা। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে জিনটাতে (Gene) সমস্যা হলে একজন মানুষ হিজড়া হয়ে যায় সেই জিনটি জেব্রাফিশ থেকে প্রথম ক্লোনিং করে তার বিভিন্ন ধরণের বৈশিষ্ট্য এনালাইসিস (Zebrafish Androgen Receptor: Isolation, Molecular, and Biochemical Characterization) করেছিলাম যা ভাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।

অনেক মাছের পোনাকে হরমোন দিয়ে ছেলে বা মেয়েতে পরিবর্তন করা যায়। তেলাপিয়া মাছ চাষে এটি বহুল ব্যবহার হয়। কেননা তেলাপিয়ার সুনির্দিষ্ট সেক্স ক্রমোজোম নেই। মাছে হরমোন ট্রিটমেন্ট লিঙ্গ পরিবর্তন করে যা স্বাভাবিক ছেলে বা মেয়ের তুলনায় কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডাররা (ট্রান্সসেক্সুয়াল) হরমোন থেরাপী বা অস্ত্রপচার করে ছেলে থেকে মেয়ে অথবা মেয়ে থেকে ছেলেতে রূপান্তিত হলেও ভিতরে অঙ্গের পরিবর্তন করা যায় না। বাহ্যিক অঙ্গকে (যেমন নারী যৌনাঙ্গ) কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে পুরুষাঙ্গের মতো করে তৈরী করা হলেও সেই মহিলা বন্ধ্যা হয়ে যায়, অর্থাৎ শিশু জন্ম দানে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। অর্থাৎ সেক্স রিডিজাইন সার্জারী জাস্ট মনের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য একটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।

মানুষের জন্ম হতে বাবার শুক্রানু এবং মা’র ডিম্বানু মিলিত হয়ে প্রথমে জাইগোট নামক যে প্রথম একটি কোষ তৈরী হয়, তখনই একজন মানুষের সেক্স বা লিঙ্গ নির্ধারিত হয়ে যায়। অর্থাৎ এটা এতই পারফেক্ট একটা জৈব প্রক্রিয়া।

ট্রান্সজেন্ডাররা আলোচনায় একটি মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল যে তাদের জেন্ডারও জন্মগতভাবে গর্ভাবস্থায় নির্দিষ্ট হয় (‘Born this way’ hypothesis)। ১৯৯৩ সালে বিশ্বমিডিয়া তোলপাড় হয় অবশেষে গে জিন (Gay Gene) আবিষ্কার হলে তা নিয়ে এলজিবিটি’র জেনেটিক ভিত্তি পাওয়া গেল বলে সে কি উন্মাদনা! আনন্দের অতিশয্যে NATIONAL GAY & LESBIAN TASK FORCE বিবৃতি দেয়- the NIH study… shows that homosexuality is a naturally occurring and common variation among humans….”.

পরবর্তীতে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের জেনেটিক ডাটা এনালাইসিস করে সায়েন্টিফিক মহল সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ‘গে জিন’ বলে কিছু পাওয়া যায়নি, জেনেটিক বৈচিত্র্যতা বা ভিন্নতা দিয়ে হোমসেক্সুয়ালি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

নিউরোবায়োলজিক্যাল (ইমেজিং টেকনোলোজি) গবেষণার মাধ্যমে নারী এবং পুরুষের মস্তিষ্কে পার্থক্য খুঁজে পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ট্রান্সজেন্ডার পরিচয় কি মস্তিষ্কের মাধ্যমে নির্ধারিত? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সালে নেদারল্যান্ডস এর নিউরোবায়োলজিস্ট ডিক সোয়াবের নেতৃত্বে একটি মৌলিক গবেষণা হয়েছিল। তিনি পুরুষ এবং মহিলা মস্তিষ্কের মধ্যে গঠনগত যে পার্থক্য রয়েছে সেই রিসার্চ প্রজেক্টেও জড়িত ছিলেন। ড সোয়াব্রর ট্রান্সজেন্ডারদের লাশের পোস্টমর্টেম থেকে প্রাপ্ত মস্তিষ্কের টিস্যুর নমুনা পরীক্ষা করে কিছুটা আশাজাগানিয়া পার্থক্য খুঁজে পেলেও তা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছা অসম্ভব। তিনি মাত্র ১২ জন মৃত ট্রান্সজেন্ডারের টিস্যু উপর এই কাজটি করেছিলেন। এরপর আরো কিছু নিউরোবায়োলজিক্যাল গবেষণা হয়েছে কিন্তু এ পর্যন্ত দাবী করার মত অগ্রগতি নেই।

বলে রাখা প্রয়োজন, এলজিবিটি আন্দোলন লাইমলাইটে এসেছিল একটি দূর্বল রিসার্চ পেপারের মাধ্যমে। মাত্র ৩০ জন সমকামি এবং ৩০ জন সাধারণ মানুষের উপর স্টাডি করে পরিংখ্যানিকভাবে নেগেটিভ কো-রিলেশন দেখিয়েছিল। এত কম স্যাম্পল সাইজ এবং দূর্বল পরিসংখ্যানের মডেল দিয়ে এ যুগে মোটামুটি জার্নালেও পেপার প্রকাশ করা সম্ভব না। কিন্তু সেই পেপারটির দলিল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে যে, সমকামিতা কোন মানসিক সমস্যা নয়। সাইকোলজি ফিল্ডে চাইলে নিজের দাবী পূরণ করার যুক্তি বের করা যায়।

ট্রান্সজেন্ডারদের সেই ‘Born this way’ হাইপোথিসিস প্রমাণে ভ্রুণ পর্যায়ে কোন হরমোনগত পার্থক্য বা ভিন্ন দেখা যায় কিনা তা নিয়ে ইন্টারসেক্স (হিজড়া) শিশুদের উপর পর্যাপ্ত রিসার্চ করেও তেমন ভিত্তি দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। এত প্রচেষ্টার পরও ট্রান্সজেন্ডারের কারন খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।

তাই এটি নিয়ে বেশী মরিয়া হলে কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির জন্য ভাল হবে না বলে বিখ্যাত সায়েন্টিফিক ম্যাগাজিন সায়েন্টিফিক আমেরিকান এই শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপে- “The Search for a ‘Cause’ of Transness Is Misguided” অর্থাৎ ট্রান্সজেন্ডারের কারন খোঁজা বিপথগামীতার নামান্তর।

লেখক: বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (বিআরএফ) বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এবং ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক।

আগের সংবাদজামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ১৫ কিশোর
পরবর্তি সংবাদপাঠ্যক্রমে ইতিহাস বিকৃতি: আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকরা বিরক্ত-বিব্রত