পাঠ্যক্রম সংশোধনের দাবী কতটা পূরণ হলো?

রাকিবুল হাসান নাঈম:

সমালোচনার মুখে ও তদন্তের মাঝপথে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ শীর্ষক পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি একই বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ শীর্ষক দুটি বই সংশোধন করা হবে। সংশোধন হবে ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞানের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের বেশকিছু অধ্যয়। শুক্রবার (১০ ফেব্রুয়ারি) ছুটির দিন হঠাৎ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এতে বলা হয়, যে তিনটি পাঠ্যবই সংশোধন করা হবে সেগুলোর বাকি পাঠ যথারীতি পড়ানো হবে। আর সংশোধিত অংশ শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হবে।

পাঠ্যবইগুলো প্রকাশের পরপরই খণ্ডিত ইতিহাস অন্তর্ভুক্তি, মুসলিম ইতিহাস বাদ দেয়া, ধর্মবিরোধী, প্রজনন স্বাস্থ্য ও ট্রান্সজেন্ডারের মতো বিষয় সম্পর্কে পাঠ রাখা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি ওঠে। এছাড়া সার্চ ইঞ্জিন গুগল থেকে হুবহু অনুবাদ তুলে দেয়া এবং অনলাইন থেকে পাঠ নেয়া হলেও লেখকের কৃতিত্ব না দেয়ার অভিযোগ আছে। এসব নিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে আপত্তি ওঠে। অভিযোগগুলো নিয়ে গত ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ সভাপতি মাওলানা হুশামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলীর নেতৃত্বে একটি দল সাক্ষাৎ করেন। তারপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু ২৪ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে দুটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন। ৩১ জানুয়ারি ওই কমিটির সদস্যদের নাম প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কমিটি কাজ শুরুর আগেই পাঠ্যবই প্রত্যাহার আর সংশোধনের ঘোষণা দেয়ার মতো ঘটনা ঘটল।

এনসিটিবি কী বলছে?

সূত্রমতে, এসব পাঠ্যবইয়ের বিষয়ে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে আকস্মিক জুম প্ল্যাটফর্মে অনলাইন বৈঠক ডাকা হয়। ওই বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব এবং এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যোগ দেন। তবে সেখানে পাঠ্যবই প্রত্যাহারের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কিন্তু বিকেল সোয়া ৩টার দিকে হঠাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ফোন করে সিদ্ধান্তের কথা এনসিটিবিকে অবহিত করেন। এর এক ঘণ্টা পর এনসিটিবির চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করে।

জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম ফাতেহকে বলেন, ‘আপত্তিকর ছবি ও দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে বই প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই দুই বই নিয়েই বেশি সমালোচনা ও আপত্তি উঠেছিল। যেকারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুইটি বই বাতিল করা হয়েছে। আমরা সিদ্ধান্তটি গতকালই আমাদের সব উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। তারা নতুন এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল আছেন। দুটি বই তো প্রত্যাহার হচ্ছে। আর যেসব বই সংশোধন হবে, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছি। তাদের (বিশেষজ্ঞ) মতামত অনুযায়ী বইগুলো সংশোধন হলে আমরা দেখবে এর আকার কেমন হচ্ছে। সংশোধনী খুব ছোট হলে আমরা তা স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেব। আর বেশি সংশোধনী আসলে আমরা পুরো বই পাল্টে দেব।’

দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে সাময়িক ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসাবে পাঠ্যবই প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান। তবে গঠিত কমিটি তাদের কাজ চালিয়ে যাবে। তাদের সুপারিশ পাওয়ার পর সময় নিয়ে ভালো করে সম্পাদনা শেষে উল্লিখিত বই প্রবর্তন করা হবে। এই সংশোধন প্রক্রিয়ায় কত সময় লাগতে পারে তার কোনো নির্দিষ্ট সময়ের কথা তিনি জানাতে পারেননি ।

ইতিহাসবিদ ও শিক্ষকরা কী বলছেন?

এ প্রসঙ্গে কথা হয় দারুন নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আ.খ.ম. আবুবকর সিদ্দীকের সঙ্গে। পাঠ্যপুস্তক ইস্যুতে শুরু থেকেই দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করে চলছেন তিনি। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘এনসিটিবির এই বই সংশোধনের ঘোষণাকে স্বাগত জানাচ্ছি। তারা বই দুটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আমরা যে সংশোধনী দিয়েছি, আশা করি সরকার সেগুলো সংশোধন করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা বলতে পারছি না। সংশোধনী কমিটি এখনও প্রতিবেদন জমা দেননি। ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ তাদের প্রথম বেঠক হয়েছে। প্রতিবেদন জমা দিতে তাদের সময় লাগবে। তবে বই প্রত্যাহারের ঘোষণাটা সরাসরি সরকারের হস্তক্ষেপে হয়েছে। সংশোধনী কামিটির পরামর্শমতে নয়।’

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. এ কে এম শাহনেওয়াজ মনে করেন, যাদেরকে সংশোধনী কমিটিতে রাখা হয়েছে, তারা আলোচ্য বিষয়ে অতটা বিশেষজ্ঞ না। তারা কতটুকু সংশোধন করতে পারবেন, তা নিয়ে তার সন্দেহ আছে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইটি পড়ে দেখেছি। তাতে পনোরো-বিশটা ভুল পেয়েছি সাধারণ দৃষ্টিতেই। ভুলগুলো নির্দিষ্ট কোনো অধ্যায়ে না, পুরো বইয়ে ছড়ানো। বিভিন্ন বিষয়ে ভুল। কোথাও তথ্যে ভুল, কোথাও ছবিতে ভুল। সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ইতিহাস বর্ণনায় ইনসাফ বজায় রাখা হয়নি। প্রাচীন যুগ নিয়ে ১০৯ পৃষ্ঠা আলোচনা করা হয়েছে, আর মধ্যযুগের মুসলিম শাসন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে মাত্র ১৪ পৃষ্ঠা। এর থেকেই বুঝা যায়, এখানে যাথেষ্ট রিসোর্স, রেফারেন্স যুক্ত করা হয়নি। যা বলার, তা বলা হয়নি। ধর্মের উর্ধ্বে উঠেও যদি বলি, তাহলেও এটা ঠিক হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘যে যুগের ইতিহাস, সে যুগের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ দিয়েই সংশোধন করাতে হবে। অন্যদের দিয়ে সংশোধন করালে ভুল থেকেই যাবে। এটা এনসিটিবির দায়িত্বশীলদের হাতে। আমি কালেরকণ্ঠে পাঠ্যপুস্তকের ভুল নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। কিন্তু ‘উপরমহলের’ নিষেধ করেছে এ বিষয়ে লেখা ছাপাতে। তাই কালেরকণ্ঠ আর এ বিষয়ে লেখা ছাপবে না। লেখটা যদি সরকার ছাপার অনুমতি দিত, তাহলে আমাদের কাছ থেকেও বিনামূলে ভুলগুলো চিহ্নিত করতে পারতো। কিন্তু এখন তো সেটা সম্ভব হবে না।’

আগের সংবাদ২০২৩ সালে আমিরাতে রোজা রাখতে হবে ১৩ ঘণ্টার বেশি
পরবর্তি সংবাদদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু