|| তাসনিফ আবীদ ||
ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নে একটি মন্দিরের মূর্তিতে আগুন ও এরপর সন্দেহের জেরে দুজন শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন মধুখালীর নওপাড়া ইউনিয়নের শাজাহান খানের ছেলে আশরাফুল খান ও তার ভাই আরসাদুল খান।
এ ঘটনা পুরো দেশে ইতোমধ্যেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এমনকি গতকাল ২৩ এপ্রিল (মঙ্গলবার) এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে হাজার হাজার জনতা মধুখালির রাজপথে নেমে আসে। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। গতকালের এই ঘটনায় আহত ও নিহতের সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়ালেও মধুখালী থানার অফিসার ইনচার্জ নিতহের বিষয়টি বানোয়াট বলে জানায় ফাতেহকে।
তিনি বলেন, তিনি জানান, হাইওয়ে রোডে ব্যারিকেড ও মানববন্ধন করার ঘটনায় জেলা পুলিশ অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই ঘটনায় কেউ নিহত হয়নি।
মধুখালীর আলোচিত এই ঘটনা নিয়ে কথা হয় স্থানীয় উলামা পরিষদের কয়েকজন দায়িত্বশীল ও সদস্যের সঙ্গে। সংগঠনটির সহ-সভাপতি মধুখালী থানার অফিসার ইনচার্জের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে একমত হয়ে জানান, গতকাল বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। তবে আমাদের জানা মতে কেউ নিহত হয় নি। একজনের অবস্থা খুবই গুরুতর। তাকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছে। সেখানে পুলিশের তত্ত্ববধানে চিকিৎসা চলমান। তবে তিনি বাঁচবেন কী না বলা যাচ্ছে না।
জানা যায়, দুজন নিরিহ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর বিষয়টির সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচারের দাবিতে গতকাল মধুখালী থানায় যায় স্থানীয় উলামা পরিষদের মাওলানা আব্দুর রহিম, হাফেজ রিয়াজুল ইসলাম, কারী আবুল কাসেম, মুফতি সাইফুদ্দীন, মাওলানা রফিকুল ইসলাম, মাওলানা মাসুম বিল্লাহ, কবির বিন সাইদ, মাওলানা রাকিবুল ইসলাম নয়ন।
এই প্রতিনিধির দলের মধ্যে কথা হয় সংগঠনের সহ-সভাপতি মাওলানা মাসুম বিল্লাহর সঙ্গে। তিনি জানান, ওসি সাহেব আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে তারা সর্বোচ্চ বিচারের চেষ্টা করবেন।
‘আমরা মানবন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালনের কথা ওসি সাহেবকে বললে ওসি সাহেব বলেছেন, আপনারা আলেমরা বিষয়টি নিয়ে একটু ধৈর্য ধরুন। আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি থাকবে না। এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা যদি ব্যর্থ হয় তখন আপনারা আন্দোলনের ডাক দিয়েন।’ –বলেন মাওলানা মাসুম বিল্লাহ
গতকাল বুধবারের মানববন্ধন ও হাইওয়েতে ব্যারিকেডের বিষয়টি কাদের আহ্বানে করা হয়েছে জানতে চাইলে মাওলানা মাসুম বিল্লাহ জানান, এর সঙ্গে স্থানীয় আলেমদের কোনো নেতৃত্ব ছিল না। কে বা কারা যেন ফেসবুকে মানববন্ধনের ঘোষণা দেয়। সেই প্রেক্ষিতে মানুষজন হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
‘সহোদর দুই ভাইকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যার বিষয়টি তো খুবই দুঃখজনক। এই বিচার যদি ঠিকভাবে না হয় তাহলে স্থানীয়ভাবে যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। গতকালের ঘটনা থেকে সেটাই বুঝা যায়। এসব ঘটনা দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টিও করতে পারে। তাই প্রসাশনকে শক্ত হাতে এগুলো দমন করতে হবে।’ –জানান তিনি
তিনি জানান, আমরা প্রসাশনের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। আমরা জানিয়েছি ফরিদপুরের আলেম সমাজ, সাধারণ মানুষ ও সর্বস্তরের জনতার মাঝে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে। পরিস্থিতি যেন আরো খারাপের দিকে না যায় সে বিষয়ে প্রসাশনকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।
মুসলিম সহদোর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদ-
ফরিদপুরের মধুখালীর ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে হেফাজতে ইসলাম।
সংগঠনটি বিবৃতিতে বলে, ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দেশ। এ দেশের অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাসে বৈচিত্র্য থাকলেও আবহমানকাল থেকেই নিজেদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার এক মন্দিরে আগুনের ঘটনায় নিছক সন্দেহের বশে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নৃশংসভাবে দুজন মুসলিম শ্রমিককে হত্যা ও পাঁচজনকে আহত করে। এমন জঘন্যতম ঘটনায় আমরা বাকরুদ্ধ। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমরা হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনায় যারপরনাই ব্যথিত ও হতবাক হয়েছি। অবিলম্বে দোষীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি। সরকার যদি এক্ষেত্রে দ্রুত যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, আর এর ফলে দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়; তাহলে সরকারকেই তার দায়ভার বহন করতে হবে।’
এদিকে ফরিদপুরের মধুখালীতে মন্দিরে আগুন দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উগ্রবাদিদের গণপিটুনিতে ৩ শ্রমিক নিহত ও পাঁচজনকে আহত করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম।
বিবৃতিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর বলেন, সম্প্রতি একটি বিশেষ সম্প্রদায় দেশে গোলযোগ বাধিয়ে দেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতেই এধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। অতীতেও দেখা গেছে বিভিন্ন মন্দিরে হামলার ঘটনায় যারা জড়িত তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দেশ । এ দেশের অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাসে বৈচিত্র থাকলেও আবহমানকাল থেকেই নিজেদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে যার যার ধর্ম পালন করে আসছে। কিন্ত ১৯ এপ্রিল ফরিদপুরের মধুখালীর এক মন্দিরে আগুনের ঘটনায় কেবলমাত্র সন্দেহ করে দুই সহোদরসহ ৩ মুসলমান শ্রমিককে হত্যা ও পাঁচজনকে আহত করার জঘন্যতম ঘটনা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
এছাড়া ফরিদপুরের মধুখালীর এক মন্দিরে আগুনের ঘটনায় নিছক সন্দেহের বশে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় দুই মুসলিম শ্রমিককে নৃশংসভাবে হত্যা ও কয়েকজনকে আহত করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রদয়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখানে মুসলিম, হিন্দু বৌদ্ধসহ অনেকে বসবাস করছে। মসজিদ মাদরাসা ও মন্দির পাশাপাশি থেকেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ভারতের নির্বাচনের পাক্কালে হিন্দুদের মন্দিরে হামলা এবং একে কেন্দ্র করে দুইজন মুসলিম শ্রমিককে নিমর্মভাবে হত্যা ও কয়েকজনকে আহত করে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। এ ঘটনার উদ্দ্যেশ্য সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। এদের চক্রান্ত দেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। দেশের মানুষ এ ঘটনায় স্তব্ধ ও মর্মাহত এবং বাকরুদ্ধ। কোনো ধরণের তদন্ত ছাড়া এভাবে দুই জন মানুষকে হত্যা করা যা কেনো ভাবেই মেনে নিতে পারি না।