কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড : একটি পর্যালোচনা (৪)

আশরাফ উদ্দীন খান

প্রথম পর্ব পড়ুন : কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড : একটি পর্যালোচনা

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন : কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড : একটি পর্যালোচনা

তৃতীয় পর্ব পড়ুন : কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড : একটি পর্যালোচনা

আলিয়া মাদরাসায় টাইটেল কোর্স প্রবর্তন ও আর্ল কনফারেন্স

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আলিয়া মাদরাসাতে দুই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। একটি মাদরাসার মূল আরবী বিভাগ, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত, যেটা ছিল স্কুল ও কলেজের সমমানের, আর দ্বিতীয়টি ছিল এংলো-পার্সিয়ান বিভাগ, যেটা ছিল সাধারণ হাইস্কুলের সমমানের। এরপরে কেউ যদি ধর্মীয় বিষয় উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করতে ইচ্ছা করত, তাহলে এই অঞ্চলে সেই ইচ্ছা পূরণ করার ব্যবস্থা ও সুযোগ ছিল না। বরং ছাত্রদেরকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করার জন্য বাংলার বাইরে যেতে হত। এই পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ ভাবলেন যে, ধর্মীয় শিক্ষাকে এই পরিমাণ উন্নত করা দরকার যাতে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য দেশের বাইরে যেতে না হয়। এই চিন্তাকে কেন্দ্র করে সরকারের কাছে কিছু প্রস্তাব পেশ করা হয়।

‘১৯০৩ সালে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন পেশ করা হয়। ফলে হাদীস ও তাফসীর বিষয়কে অতিরিক্ত বিষয় হিসাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে তদানীন্তন ডি.পি.আই. (ডিরেক্টরি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন) বা জনশিক্ষা বিভাগ তার পাঁচসালা (১৯০২-১৯০৬) পরিকল্পনা রিপোর্টে উচ্চশিক্ষার এই বিষয়টি একটি কনফারেন্সে আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন করার কথা উল্লেখ করে।

‘জনশিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে পাঁচ বছরের রিপোর্ট পেশ করা হয়। ১৯০২-১৯০৬ সালের এই রিপোর্টে আলীয়া মাদ্রাসা সম্পর্কে বলা হয়, “আলিয়া মাদ্রাসাতে দুইটি বিভাগ রয়েছে যাতে দুই ধরণের শিক্ষা দেওয়া হয়। একটিতে ইংরেজি (এংলো-পার্সিয়ান) ও অপরটি মাদরাসার মূল আরবী শিক্ষা অর্থাৎ প্রাচ্য দেশীয় শিক্ষা। ইংরেজি বিভাগটি একটি সাধারণ হাইস্কুল মানের আর আরবী বিভাগের ছাত্ররা স্কুল ও কলেজের শিক্ষা বিষয়সমূহ এগার বছর ধরে পড়াশোনা করে থাকে।

‘“এই দুই পদ্ধতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল–আরবী বিভাগের যেসব ছাত্র ইংরেজি শিখতে চায় তারা আরবী বিভাগে পড়া শেষ করে, যথা নিয়মে এংলো পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হতে পারত। একইভাবে এংলো পার্সিয়ান বিভাগের কোনো ছাত্র আরবি শিখতে চাইলে নিজ বিভাগের পড়া শেষ করে আরবী বিভাগে ভর্তি হতে পারত। কিন্তু কুরআন, হাদিস, তাফসীর প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চতর কোনো লেখাপড়া বাংলাদেশের কোথাও ছিল না। কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়া শেষ করে ভারতে উত্তর প্রদেশের কতিপয় মাদ্রাসায় গিয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করতে হতো। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের ছাত্রদের যেন বাংলাদেশেই উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করতে পারে, এরুপ শিক্ষাক্রম প্রবর্তননের দাবী ওঠে। সরকার নীতিগতভাবে এই দাবী মেনে হয়। ১৯০৩ সালের ২৪ শে ফেব্রুরায়ি হাদিস, তাফসীর, ইসলামের ইতিহাস ও ভূগোল বিষয়কে সিলেবাসভুক্ত করা হয়।”

‘মাদরাসা শিক্ষার মান নিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, “একদিকে মাদ্রাসাকে সাধারণ ইংরেজি কলেজের মান অবধি ধরা যেতে পারে, তবে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণেচ্ছু ছাত্ররা এই কলেজে ভর্তি হতে পারে, তবে তাদের শিক্ষার নির্দিষ্ট কলেজ হল প্রেসিডেন্সী কলেজ।”

‘আরবী বিভাগে স্কুল ও কলেজের পাঠ্য বিষয় এগার বছরের মধ্যে সীমিত। শিক্ষার মাধ্যম উর্দু, তবে উপরের কয়েকটি ক্লাসে কোনো কোনো বিষয় ফার্সিতেও শিক্ষা দেওয়া হয়। এই বিভাগে আরবী ও ফার্সি সাহিত্য ছাড়াও বিভিন্ন ইসলামী বিষয়, যেমন ফিকাহ, মানতেক, বালাগাত, হেকমত, কুরআনের তাফসীর, হাদিস ও দীনিয়াত শিক্ষা দেওয়া হয়। এখানে ইংরেজিও শিক্ষা দেওয়া হয়। শতকরা ৫৬ জন ছাত্র এতে অংশগ্রহণ করে।’ (আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ১৫৭-১৫৯), (বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৬১-১৬২)

আর্ল কনফারেন্স ১৯০৭ সাল

ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯০৩ সালে মুসলমানদের পক্ষ থেকে আরবী শিক্ষার সংস্কারের জন্যে একটি প্রস্তাবপত্র পেশ করা হয়েছিল এবং সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে তাফসীর ও হাদিস বিষয়কে এডিশনাল বিষয় হিসাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল এবং এই ব্যাপারে ভবিষ্যতে আরো বিবেচনা করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এবং জনশিক্ষা বিভাগের রিপোর্টে এই বিষয়ে একটি কনফারেন্স সম্পন্ন হবে বলে ইংগিত দেওয়া হয়েছিল।

‘১৯০৭ সালে জনশিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর আরসেল আর্লকে মুসলমান শিক্ষা সম্পর্কিত একটি চূড়ান্ত সম্মেলনের আয়োজন করার জন্যে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সম্মেলনের জন্যে বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের প্রতিনিধি মনোনয়ন করা হয়েছিল। সম্মেলন শেষ, মিঃ আর্ল মাদরাসাশিক্ষা সম্পর্কিত একটি চূড়ান্ত সংস্কারমূলক রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করেন। এই রিপোর্টকেই আর্ল কমিটির রিপোর্ট বলা হয়।

‘সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে তিনটি সাব কমিটি গঠন করা হয় ও তাদের বিবেচনার জন্য তিনটি বিষয় নির্ধারণ করা হয়।
১. প্রথম সাব-কমিটির দায়িত্ব ছিলঃ মাদ্রাসায় টাইটেল ক্লাস পত্তন, মাদ্রাসার শিক্ষাক্রমের পুনর্বিন্যাস ও ইংরেজি শিক্ষা সম্পর্কিত সমস্যাদি চিহ্নিত করে তার সমাধানের উপর সুচিন্তিত মতামত পেশ।
২. দ্বিতীয় সাব-কমিটির দায়িত্ব ছিলঃ মক্তব শিক্ষার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ সম্পর্কে বিবেচনা করা।
৩. তৃতীয় সাব-কমিটির দায়িত্ব ছিলঃ বাংলাদেশে উর্দুর ভবিষ্যৎ কিভাবে নিরূপণ করা যায়, সেই বিষয়ে মতামত পেশ করা।

এই তিনটি সাব-কমিটি তাদের রিপোর্ট ১৯০৮ সালের মার্চে জমা দেয়। অতঃপর একই বছরের ২২ শে এপ্রিল সম্মেলনের পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং রিপোর্টের আলোকে সমুদয় বিষয় সরকারের কাছে পেশ করা হয়।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৬৭-১৭০)

আর্ল কমিটির রিপোর্টের সংক্ষিপ্তসার

উক্ত কমিটিতে বিশেষভাবে আলোচনা করা হয় এই বিষয় যে, আলিয়া মাদ্রাসায় টাইটেল ক্লাস চালু করা হবে কি না–সেটা নিয়ে। সেই আলোচনার বিষয় কিছু অংশ সামনে উল্লেখ করা হলো–

১. সরকারী চাকুরীর ব্যাপারে, সরকার শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর অগ্রাধিকার প্রদান করেন, অথচ ইংরেজি বাদে মাদ্রাসার ছাত্ররা অন্য কোন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারীদের চেয়ে কম নয়। এখন মাদ্রাসার ছাত্রদের সরকারী চাকুরীতে কিভাবে বহাল করা যায় সেটাই চিন্তার বিষয়। জনশিক্ষা বিভাগের ধারা অনুযায়ী ইংরেজি ভাষা মাদরাসার বাধ্যতামূলক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়, আর ঐচ্ছিকভাবে কলিকাতা ও হুগলী মাদ্রাসার ছাত্ররা যেটুকু ইংরেজি অধ্যয়ন করে সেটার মানও তেমন উন্নত হয়। এই জন্যে মাদরাসার শিক্ষা বিষয়ে ইংরেজি শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে মাদরাসার ছাত্ররা সরকারী চাকুরি লাভে সমর্থ হয়।

২. যদি টাইটেল ক্লাসের পত্তন করে মাদরাসায় ইংরেজি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় তাহলে বর্তমানে পাঠ্য বিষয়ের উপর সেটা খুব প্রভাব বিস্তার করবে। এই পাঠ্য বিষয়ের সংস্কারের প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছিল ১৯০৩ সালে এবং কিছুটা সংশোধন করাও হয়েছিল। ইতিহাস, ভূগোলকে বিষয়ভুক্ত করে হাদীস, তাফসীরের উপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে যদি আরবী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখতে হয় তাহলে এর চেয়ে বেশী সংশোধন বা সংস্কার সম্ভব নয়। স্কুলের বিষয়াদি যদি মাদরাসায় চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আরবী শিক্ষার উদ্দেশ্য নস্যাৎ হয়ে যাবে। আরবী শিক্ষাকে যদি যথার্থ সুপরিকল্পিতভাবে পড়ানো হয় তাহলে এই শিক্ষাও একটি উৎকৃষ্টমানের শিক্ষায় পরিণত হবে, তবে এর পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার যে, মাদরাসায় ইংরেজি বিষয়াদি প্রবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।

৩. যদি টাইটেল ক্লাস সরকার অনুমোদন করেন তাবে আরবী শিক্ষা পরিপূর্ণতা লাভ করবে। এটা সত্য যে, এই সংশোধন সম্পর্কিত প্রস্তাবাবলীর সাথে মাদরাসার এংলো পার্সিয়ান বিভাগের কোন সম্পর্ক নেই। কেননা এটা একটি হাইস্কুলের পর্যায়ে চলছে এবং এই সম্পর্কে মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের উন্নয়ন পরিকল্পনাধীনে বিবেচনা করা যেতে পারে। শুধুমাত্র আলিয়া মাদরাসায় টাইটেল ক্লাস চালু করা হবে, বাংলাদেশের অন্যান্য মাদ্রাসার জুনিয়র ও সিনিয়র ক্লাসসমূহ আগে যেমন ছিল তেমনই বলবৎ থাকবে।

৪. আলিয়া মাদরাসার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক একটি আলোচনা উত্থাপিত হয়। আমাদের পর্যালোচনায় মাদরাসার সিনিয়র পর্যায়ের ক্লাসগুলিকে কলেজের সমমানের বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। মাদরাসার সিনিয়র ক্লাসের ছাত্ররা এম, এ, বা তৎসমতুল্য ক্লাসের আরবীর চেয়েও কঠিন পুস্তকাদি অধ্যয়ন করে। সিনিয়র ক্লাসগুলিতে দর্শন, মানতেক, বালাগাত, আকায়েদ, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ এর মতো বিষয়াদি পড়ানো হয়। এইগুলি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ানো নয়, তবে পার্থক্য শুধু ভাষার।

উক্ত সম্মেলনে কিছু প্রগতিশীল লোক ছিলেন। তারা মাদরাসাশিক্ষাকে সম্পুর্ণ আধুনিকীকরণের পক্ষপাতী ছিলেন। তাদের মতে মাদরাসায় ইংরেজি বাধ্যতামূলকভাবে রাখতে হবে এবং পাঠ্যপুস্তক এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যেন মাদরাসার ছাত্ররা নির্বিঘ্নে স্কুলে গিয়ে ভর্তি হতে পার। অর্থাৎ তাদের ইচ্ছা হলো একটা বিশেষ মান অবধি মাদ্রাসায় দুই ধরণের শিক্ষা চালু করতে হবে। এক বিভাগে ইংরেজি ও আরবি আর অন্য বিভাগে শুধু আরবি শিক্ষা দিতে হবে।

পক্ষান্তরে এখানে এমন কিছু লোক ছিলেন যারা এর বিপরীতে অবস্থান নেন। তাদের মতে, আরবী যেমন ছিল তেমন থাকবে এবং এর মান আরো উন্নত করতে হবে, কোন ক্রমেই ইংরেজি বিষয় বাধ্যতামূলক হবে না।

এই ব্যাপারে কমিটির সভাপতি তাঁর নিজের বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে বলেন, আমার বক্তব্য দ্বিতীয় মতের অনুরূপ। কেননা, এই দল সরকারী মতের স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। সরকার হাদিস ও তাফসীর শিক্ষাকে অনুমোদন করেছেন, যার মাধ্যমে আরবি শিক্ষা যথার্থভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। হাদীস, তাফসীরের উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্যই ছাত্ররা যুক্তপ্রদেশ ও পাঞ্জাব অঞ্চলে গিয়ে থাকে। ছাত্রদের এই অসুবিধা দূর করার জন্যই এখানে হাদীস-তাফসীর পাঠ্যভুক্ত করা হয়েছে। অতএব মাদ্রাসা শিক্ষায় টাইটেল ক্লাস প্রবর্তন না করলে আরবী শিক্ষার উদ্দেশ্য পদে পদে ব্যাহত হবে, তেমনি এই শিক্ষাও অসম্পুর্ণ থেকে যাবে। অতএব টাইটেল ক্লাস প্রবর্তনের প্রশ্নটি সম্পীর্ণ অপরিহার্য।

সর্বশেষ আগত প্রতিনিধিদের মাঝে প্রগতিবাদী বনাম টাইটেলপন্থীদের মাঝে ভোট নেওয়া হয়। এবং ভোটে প্রগতিবাদীরা পরাজিত হন। (আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ১৬৩-১৬৭)

প্রস্তাবিত টাইটেল কোর্সের পাঠ্যবিষয়

টাইটেল কোর্সে চারটি বিভাগের প্রস্তাব করা হয়। যা হচ্ছে : হাদীস বিভাগ, ফিকাহ বিভাগ, আদব বিভাগ ও হেকমত বিভাগ। সকল বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা পাঠ্য বিষয় প্রস্তাব করা হয়। প্রত্যেকটি বিভাগের শিক্ষাকাল নির্ধারণ করা হয় ৩ বছরের। সামনে হাদিস বিভাগের তিন বছরের পাঠ্য বিষয় দেখানো হল–
১. প্রথম বর্ষ : মাকামাতে হারিরি, কিতাবুল আগানি, বানাতে ছায়াদ হামাছা, তিরমিজি, ইবনে মাজা, মুসলিম শরীফ, ফারায়েজ, আকায়েদে জালালি, ছোফরা, শামসে বাজেগাহ, কাজি মোবারক।
২. দ্বিতীয় বর্ষ : আবু দাউদ, নাসায়ি, কাশশাফে কামেল, তাফসিরে আছায়েল শরহে মাকাছেক।
৩. তৃতীয় বর্ষ : বুখারি, মুসলিম, তাফসীরে তাবারি, শরহে মাওয়াফেক।

টাইটেলের আরো তিনটি বিভাগ তথা ফিকাহ, আদব ও হেকমতের জন্যে আলাদা পাঠ্যসুচি নির্ধারণ করা হয় ও টাইটেল পাসের ডিগ্রীসমূহ নির্ধারণ করা হয়। ডিগ্রীসমূহের ব্যাপারে বলা হয়–টাইটেলের মোট চারটি বিভাগের ডিগ্রীসমূহের নামকরণ হবে এই– ১. তাজুল মুহাদ্দেসীন। ২. তাজুল ফুকাহা। ৩. তাজুল উদাবা। ৪. তাজুল হুকামা।

কেউ আবার ‘তাজ’ শব্দের পরিবর্তে ‘ফখর’ শব্দ ব্যবহার করার প্রস্তাব করেন অর্থাৎ ‘ফখরুল মুহাদ্দেসীন। (আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ১৬৭-১৬৮)

আর্ল রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পদক্ষেপ 

১৯০৮ সালে বাংলা সরকারের কাছে এই রিপোর্ট পেশ করা হয়। সরকার কমিটির সকল সুপারিশ অনুমোদন করেন এবং এই রিপোর্টের ভিত্তিতে মাদ্রাসার সকল ক্লাস নতুন পদ্ধতিতে শ্রেণী বিন্যাস করা হয় পাঠ্য বিষয়েও রদবদল করা হয় এবং তিনজন নতুন শিক্ষকের পদও সৃষ্টি করা হয়। পদগুলো হলো–১. সহকারী মৌলবী গ্রেড। ২. সহকারী মৌলবী। ৩. ভার্ণাকুলার টিচার।

১৯০৯-১৯১০ সালে কলিকাতা ও হুগলী মাদরাসায় আর্ল কমিটির মতে নতুন শিক্ষানীতি ও পাঠ্য বিষয় চালু করা হয়। পুর্বে মাদরাসার সর্বমোট ক্লাস ছিল ৮টি, এখন ক্লাস হলো ১১টি (৬টি জুনিয়র ও ৫টি সিনিয়র)। সিনিয়র ক্লাসের সাথে আর তিনটি ক্লাস টাইটেলের জন্য প্রবর্তন করা হয়। টাইটেল ক্লাস ছিল পোষ্ট গ্রাজুয়েট ক্লাসের সমমানের। টাইটেল ক্লাসের হাদীস ও তাফসীর বিভাগের উদ্বোধন করা হয় ১৯০৯ সালে।

আর্ল কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী জুনিয়র তৃতীয় মান অবধি ফার্সিকে বাধ্যতামূলক ও উপরস্থ ক্লাসের যেসব ছাত্র ইংরেজিসহ আরবী পড়ছে তাদের জন্যে ফার্সিকে ঐচ্ছিক করা হয়। অথচ ইতিপুর্বে মাদরাসাশিক্ষায় ফার্সির প্রাধান্যই ছিল। ফার্সি না জানলে কোন লোকই সমাজে সম্মানের দাবিদার হতে পারত না। কিন্তু এই নতুন পরিবর্তনের প্রভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা হতে ক্রমান্বয়ে ফার্সি বিদায় নিতে শুরু করে। (আলিয়া মাদরাসার ইতিহাস, পৃঃ ১৭১-১৭২)

আর্ল কমিটির রিপোর্টের সমালোচনা

এই কনফারেন্সে রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল এই দুই ধরণের লোক অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানেই মাদরাসাশিক্ষার পরিবর্তন নিয়ে তুমুল বাক-বিতণ্ডা হয়েছিল। চরম প্রগতিপন্থী আর্ল কমিটির এই সামান্যতম পরিবর্তন মোটেই আমল দিলেন না। তাদের মতে মাদরাসাশিক্ষায় আমূল পরিবর্তন করতে হবে। তাদের মতে মাদরাসায় পর্যাপ্তভাবে ইংরেজি প্রবর্তন করতে হবে, তবে এই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষাও থাকবে। ফলে তারা আর্ল কমিটির রিপোর্ট সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাদের এই বিকল্প পরিকল্পনা কার্যকরি করার জন্য ঢাকায় আরেকটি পাল্টা কনফারেন্সের আহ্বান করেন।

এই পাল্টা কনফারেন্সে আর্ল কমিটির রিপোর্টের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয় এবং এই সব ধারা সংশোধনের উপর খসড়া প্রণয়ন করা হয়। এবং শেষাবধি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশে আর্ল কমিটির রিপোর্ট কোনক্রমেই কার্যকরী হতে পারে না। কনফারেন্স শেষে একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে পুর্ব বাংলা ও আসামের শিক্ষা প্রধান মিঃ সার্টের নিকট পেশ করা হয়। কিন্তু মিঃ সার্ট রিপোর্ট পড়ে মন্তব্য করেন যে, এই রিপোর্ট এই দুই প্রদেশে কার্যকর করার জন্য নির্দেশ দিতে পারি না। (আলিয়া মাদরাসার ইতিহাস, পৃঃ ১৭৩)

আর্ল কমিটির এই পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে মাদরাসাশিক্ষায় একটি মৌলিক পরিবর্তন আসে। পূর্বের ১১ বছর মেয়াদি পাঠ্যসুচির পরিবর্তে ১৪ বছর মেয়াদি পাঠ্যসূচী প্রবর্তিত হয়। ৬ বছরের জুনিয়র কোর্স, ৫ বছরের সিনিয়র কোর্স মিলে ১১ বছর ও সেই সাথে আরো ৩ বছরের উচ্চতর টাইটেল কোর্স চালু করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

আর্ল কমিটির রিপোর্টের আলোকে মাদ্রাসা শিক্ষার পুর্ণ কোর্স ছিল নিম্নরূপ–
১. জুনিয়র স্তর : ৬ বছর, যার প্রধান বিষয়বস্তু : হাতের লেখা, অংক, উর্দু, ফার্সী, ইতিহাস, ভূগোল, আরবি।
২. সিনিয়র স্তর : ৫ বছর, প্রধান বিষয়বস্তু : আরবী ব্যকরণ, আরবী সাহিত্য, অনুবাদ, রচনা, ফিকাহ, ফার্সী সাহিত্য, রচনা, উসুলে ফিকাহ, তর্কবিদ্যা, অলংকার শাস্ত্র, জ্যামিতি, আকায়িদ, মানতিক, দর্শন।
৩. টাইটেল স্তর : ৩ বছর, প্রথম বছরের বিষয়বস্তু : আরবী সাহিত্য, হাদীস, তাফসীর, অলংকার শাস্ত্র, দর্শন ও তর্কশাস্ত্র, আকায়িদ।
৪. টাইটেলের ২য় ও ৩য় বর্ষ ছিল হাদিস, ফিকাহ, আরবি সাহিত্য ও দর্শন–এই চার ভাগে বিভক্ত।

শামসুল ওলামা আবু নছর ওহীদের প্রস্তাব

অন্যদিকে মাদরাসাশিক্ষার আমূল সংস্কারের প্রবক্তা শামসুল ওলামা আবু নছর ওহীদ (১৮৭২-১৯৫৯) আর্ল কমিটির ১৪ বছরের শিক্ষাধারার বিপরীতে ১৮ বছরের আরেকটি বিস্তারিত সিলেবাস ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯০৯ সালের ২৪ ও ২৭ জানুয়ারির সভায় পেশ করেন। তাঁর সিলেবাস ছিল তিন ভাগে বিভক্ত–১. জুনিয়র ডিপার্টমেন্ট : ৭ বছর। ২. সিনিয়র ডিপার্টমেন্ট : এংলো-ওরিয়েন্টাল কোর্স : ৪ বছর। ৩. সিনিয়র ডিপার্টমেন্ট, ওরিয়েন্টাল কোর্স : ৪ বছর।

প্রস্তাবিত সিলেবাসের বিস্তারিত রূপরেখা ছিল নিম্নরূপ–
১. জুনিয়র ডিপার্টমেন্ট : মেয়াদ ৭ বছর। বিষয়বস্তু : উর্দু পাঠ, উর্দু লেখা, উর্দু ব্যকরণ, উর্দু কথোপকথন, পাটি গণিত, জ্যামিতি, ভূগোল, ইংরেজি পাঠ, ইংরেজি লিখন, ইংরেজি ব্যাকরণ, ইংরেজি অনুবাদ, ইংরেজি কথোপকথন, আরবী পাঠ, আরবী ব্যাকরণ, আরবি অনুবাদ, ফার্সি, অংকন ও হাতের কাজ, ড্রিল।
২. সিনিয়র ডিপার্টমেন্ট : মেয়াদ ৪ বছর (এংলো ওরিয়েন্টাল কোর্স ৮ম, ৯ম, ১০ম ও ১১শ শ্রেণী)। বিষয়বস্তু : আরবি পাঠ, কথোপকথন, ব্যাকরণ, অনুবাদ, রচনা, অলংকার শাস্ত্র, ইসলামের মূলনীতি বা থিওলজী, নীতি বিজ্ঞান, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, মানতিক, হাদীস, তাফসীর, দর্শন, পদার্থ বিজ্ঞান, ইংরেজি, ম্যাথম্যাটিকস, পাটি গণিত, জ্যামিতি, বীজ গণিত অথবা ফার্সী।
৩. সিনিয়র ডিপার্টমেন্ট : ওরিয়েন্টাল কোর্সের চার বছরের বিষয়বস্তু : আরবী, ইসলামের মূলনীতি বা থিওলজী, নীতিবিদ্যা, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, মানতিক, হাদিস, তাফসীর, ইতিহাস, দর্শন, পাটি গণিত, জ্যামিতি, ফার্সী, পার‍্যসের ইতিহাস।

জুনিয়র ডিপার্টমেন্ট পাস করলে, শিক্ষার্থীদের জন্য তিনটি বিকল্প শাখা রাখা হয়েছিল :
১. সাধারণ হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে ৮ম, ৯ম, ১০ম ও ১১শ শ্রেণী অধ্যায়ন করে কলেজে ভর্তি হতে পারবে।
২. এংলো ওরিয়েন্টাল বিভাগে ভর্তি হয়ে ৪ বছরের সিনিয়র কোর্স করতে পারবে।
৩. এংলো ওরিয়েন্টাল কোর্সে ভর্তি হয়ে অনুরূপভাবে ৮ম, ৯ম, ১০ম ও ১১শ শ্রেণীতে ৪ বছরের কোর্স অধ্যয়ন করার সুযোগ ছিল।

আবু নছর ওহীদ ১৪ বছরের কোর্সের সাথে ৪ বছরের মক্তব কোর্সের পক্ষপাতী ছিলেন। এতে বাংলা, আরবি, উর্দু, ইংরেজি, কুরআন প্রভৃতি বিষয় পড়া ও লেখা শিক্ষার কাজ শেষ করা হতো। এরূপ যোগ্যতা থাকলেই কেউ জুনিয়র ১ম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।

সরকারী সিদ্ধান্ত বাধাগ্রস্ত করা এবং শিক্ষাধারা ও শিক্ষাক্রম নিয়ে ঢাকা মাদরাসার সুপারিনডেনটেন্ট শামসুল ওলামা আবু নছর ওহীদ যেহেতু বেশী তৎপরতা দেখালেন, সেজন্য তাকে ও.এস.ডি (অন স্পেশাল ডিওটি) করে রাখা হয়। তথাপি তিনি মাদরাসাশিক্ষার সংস্কারের আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকলেন। তিনি তাঁর প্রণীত পাঠ্যসূচী আলেমদের নিকট পাঠিয়ে মতামত নিয়ে সরকারকে অনুরোধ করেন। ২৫ জন বিশেষজ্ঞ আলেমের নিকট পাঠ্যসূচী পাঠিয়ে তাদের মতামত সংগ্রহ করেন। আলেমগণ তাঁর প্রণীত পাঠ্যসূচীকে যথার্থ বলে রায় দেন। আল্লামা শিবলী নোমানী স্পষ্টত বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি, আর এখানেও বলছি যে, মুসলমানদের জন্য শুধু ইংরেজি মাদরাসাশিক্ষাই যথেষ্ট নয়, আবার প্রাচীন আরবী মাদরাসাশিক্ষাও পর্যাপ্ত নয়। আমাদের সমস্যার সমাধান হলো একটি মিশ্র ঔষুধ যার একটির সম্পর্ক হবে প্রাচ্য, আর অপরটি হবে প্রতীচ্য।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৭৯-১৮২)

নিউ স্কিম মাদরাসার প্রবর্তন : হেনরী সার্পের কমিটি, ১৯০৯ সাল

১৯০৯ সালে পূর্ব বঙ্গ ও আসাম প্রদেশের জনশিক্ষা পরিচালক হেনরী সার্পের নেতৃত্বে মাদ্রাসাশিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। উক্ত মাদ্রাসাশিক্ষা সংস্কার কমিটি ১৯১০ সালের ২১ ও ২২শে মার্চের অধিবেশনে কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পূর্ব বাংলা ও আসামের প্রগতিবাদীদের মনঃপুত এই নতুন শিক্ষা পদ্ধতিই পরবর্তীতে কয়েকটি সংশোধনের উপর নিউ স্কিম নামে পরিচিতি লাভ করে। এই নতুন স্কিম অনুসারে জুনিয়র ডিপার্টমেন্ট কোর্সে ফার্সি বাধ্যতামূলক থাকবে না। বাংলা ভাষাকে বেশির ভাগ মাদ্রাসাই শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে এবং ভিন্ন একটি বিষয় হিসাবে শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ ছাড়াও আরো কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় :
*উর্দু একটি ভিন্ন বিষয় হিসাবেই সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
*আরবি ছাড়া আর সব বিষয়ে শিক্ষার মাধ্যম অবশ্যই বাংলা হবে।
*পাটি গণিত, জ্যামিতি, ভূগোল, ইতিহাস, বাংলা ভাষার মাধ্যমে পড়াতে হবে।
*ফার্সির স্থলে ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণীর বাংলা পড়ানো হবে।

পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশে) আর্ল কমিটির (১৯০৮) সুপারিশ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। উপরন্তু বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কারবাদীরা উপরোক্ত যে শিক্ষা ধারার খসড়া প্রণয়ন করেন তা কার্যকর করার জন্য শিক্ষা বিভাগের প্রধান সার্পকে আনুরোধ জানান। কিন্তু সার্প মন্তব্য করেন, আমি দুই প্রদেশের জন্য দুই প্রকার শিক্ষাধারা কার্যকর করার নির্দেশ দিতে পারি না। কেননা রিপোর্টে এমন কতগুলো বিষয় ও ধারা রয়েছে যা এখানকার শিক্ষা পরিবেশে সফলকাম হবে না। তবে এই স্কিম পরীক্ষামূলকভাবে কোন সরকারী মাদ্রাসায় চালু করে দেখা যেতে পারে।

সার্পের পরে, শিক্ষা বিভাগের প্রধানের দায়িত্বভাগ গ্রহণ করেন মিঃ নাথান। নাথানের নিকট বিষয়টি উত্থাপিত হলে তিনি ১৯১২ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ই এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত ডিপার্টমেন্টাল মাদ্রাসা কনফারেন্সে সমুদয় প্রস্তাব পুনরায় আলোচনার জন্য উত্থাপন করেন। এই কনফারেন্সে উত্থাপিত প্রস্তাবের অনুকূলে আলোচনা হয়। ফলে জুনিয়র কোর্সের ৩য় শ্রেণী হতে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত আরবি শিক্ষার পিরিয়ড কমিয়ে এনে সেখানে ইংরেজি শিক্ষার পিরিয়ড বাড়ানোর কথা বলা হয়। যাতে হাই স্কুল ইংলিশ স্কুলের সাথে এর যোগাযোগ রক্ষা কড়া যায়। এই কনফারেন্সে উর্দু পাঠের সময় কমিয়ে এনে বাংলা ভাষা শিক্ষা উপর বেশী সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাছাড়া জুনিয়র ও সিনিয়র কোর্সে ফার্সি উঠিয়ে দিয়ে সেখানে ইংরেজির পিরিয়ড আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯১২ সালে ভারত সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্তনের প্রস্তাব মঞ্জুর করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের পাশাপাশি ইসলামিয়াত বিভাগ খোলার প্রস্তাব আনা হয়। ভারত সরকারের নির্দেশক্রমে, বাংলা সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্তনের জন্যে একটি কমিটি গঠন করেন। সেই সাথে ইসলামিয়াত বিভাগ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও কাঠামো স্থির করার জন্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়। যেই কমিটির প্রধান ছিলেন মিঃ নাথন, ও তার সাথে আরো ছিলেন আল্লামা শিবলী নোমানী, আল্লামা সুলাইমান নাদভী, শামসুল ওলামা আবু নসর ওয়াহিদ সহ আরো ৯ জন। এই কমিটি পত্তনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়ঃ “গত কয়েক বছর যাবত পুর্ব বাংলার ও পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের মধ্যে মাদ্রাসার বর্তমান প্রচলিত শিক্ষা বিষয়ে অসন্তোষ পরিলক্ষিত হচ্ছে। লোকদের ধারণা মাদ্রাসার বর্তমান শিক্ষা বিষয় জ্ঞানার্জনের জন্য যেমন অপ্রতুল তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থাও খুবই প্রাচীন। তাই এই সব প্রতিষ্ঠান থেকে যে সব ছাত্র লেখাপড়া শেষ করে বের হয় তারা সমাজের আগাছা বলিয়াই প্রতিপন্ন হয়। লোকদের ইচ্ছা, মাদ্রাসা শিক্ষার আমূল পরিবর্তন করে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। এই পরিবর্তন ও সংশোধনের প্রশ্নে গত এক শতাব্দী যাবত বহু রকম চেষ্টা চরিত্র চালানো হয়েছে এবং এই শিক্ষার বহু উত্থান-পতন ও ভাঙ্গাগড়া গত হয়েছে।

১৯০৯-১০ সালে ঢাকা কনফারেন্স যে প্রস্তাবাদি গ্রহণ করে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। তাই এই জন্য একটি আলাদা পাঠ্য বিষয়ের খসড়া রচনা করা হয় এবং সেই খসড়া পর্যালোচনা ও সংশোধনের জন্যে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের নিকট প্রেরণ করা হয়।

এই স্কীম অনুযায়ী মাদ্রাসার ক্লাসসমূহকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। মাদ্রাসার জুনিয়র বিভাগের ছয়টি ক্লাস ও সিনিয়র বিভাগের চারটি ক্লাসের সুপারিশ করেন। জুনিয়র ক্লাসের পাঠ্য বিষয়ের কোন পরিবর্তন করলেন না, তবে সিনিয়র ক্লাসের পাঠ্য পুস্তকের উল্লেখযোগ্য রদবদল করেন। এই স্কিম কার্যকর করার জন্যে ১৯১৩ সালে আবার একটি কনফারেন্সের আহ্বান করা হয়, যার সভাপতিত্ব করেন রবার্ট নাথন। কমিটির সমুদয় সুপারিশ সামান্য সংশোধন পুর্বক গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন ক্লাসের বিষয়াদি নিম্নরুপ প্রবর্তন করা হয় :
*জুনিয়র ক্লাস : উর্দু, বাংলা, অংক, ভূগোল, ইতিহাস, ইংরেজি, আরবী, সাহিত্য, ড্রইং, হস্তশিল্প ও ড্রিল।
*সিনিয়র ক্লাস : আরবী সাহিত্য, ইংরেজি, অংকের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

এই স্কিম সরকারের মনঃপুত হওয়ার কারণে, অবিলম্বে তা মঞ্জুর করেন এবং ঘোষণা দেন যে, কলিকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া এই স্কিম প্রদেশের (বাংলা) সকল মাদ্রাসায় কার্যকরি করা হবে। বলা যায় যে, এই স্কিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ছাত্র তৈরির পক্ষে বিশেষ সহায়ক হবে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এই স্কিম কোনক্রমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং এটা একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ শিক্ষা স্কিম।

এই নতুন স্কিমের বিশেষত্ব হলো, এতে ফার্সিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। ফার্সির স্থলে ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইতিপুর্বে পঞ্চাশ বছর আগেও ফার্সির প্রাধান্য ছিল, কিন্তু এখনকার চিন্তাশীল মহল এই ব্যাপারে সর্বসম্মত যে, নিম্নস্তরের ক্লাসগুলোতে ছাত্রদের পক্ষে এক সাথে চার-পাঁচটি ভাষা আয়ত্ব করা খুবই কষ্টকর। ফার্সি ছাড়া আর বাকি ভাষা ছাত্রদের না পড়ালে চলে না, কারণ বাংলা মার্তৃভাষা হিসাবে পড়তেই হবে, উর্দু পাক-ভারতের একমাত্র প্রভাবশালী ও ধর্মীয় শিক্ষার বাহন, ইংরেজি না পড়লে চাকুরি ও জীবিকার ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া যায় না, আর ধর্মীয় ভাষা হিসাবে আরবী মুসলমানদের অপরিহার্য ভাষা।

যেসব প্রতিষ্ঠান এই স্কিম যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্যে অগ্রসর হল, সেসব প্রতিষ্ঠানের অর্ধেক ব্যয়ভার সরকার বহন করবে। ১৯১৪ সালে সরকার এই নিউ স্কীম শিক্ষাধারা অনুমোদন করেন। এবং ১৯১৫ সালের পহেলা এপ্রিল থেকে এই স্কিম সর্বত্র চালু হয় এবং এভাবে বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার একটি যুগান্তকারী শিক্ষা স্কিম প্রবর্তিত হয়। (আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ১৭৪-১৭৭)

নিউ স্কিম মাদরাসা প্রবর্তনের প্রতিক্রিয়া

“১৯১৪ সালের ৩১শে জুলাই নিউ স্কীম মাদ্রাসাশিক্ষাধারা সরকারের অনুমোদন লাভ করেছিল এবং ১৯১৫ সালের ১লা এপ্রিল থেকে তা পুরোপুরি কার্যকর হয়। দীর্ঘকাল পরে হলেও, এই শিক্ষাধারা প্রগতিপন্থী মুসলমানদের বিজয় সূচনা করে। ব্রিটিশ সরকার প্রায় একশ বছর পুর্বে যা চেয়েছিল তা একশ বছর পরে কার্যে পরিণত হলো। এই শিক্ষাধারা বাস্তবায়নের ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজে ধর্মপ্রাণ লোকদের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার হয়। এতদিন ইংরেজি শিক্ষার সুবিধা বিবেচনা করে অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন যে, সন্তান মাদ্রাসায় পড়াবে না স্কুলে পড়াবে। তাদের জন্য নিউ স্কীম এক আনন্দদায়ক সমাধান এনে দেয়। এই শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন স্কুলের সাধারণ বিষয়ের সমকালীন শিক্ষাধারার সাথে পরিচিত হতে পারবে, তেমনি ধর্মীয় জ্ঞানেও পারদর্শী হতে পারবে। ফলে এই ধারার শিক্ষার্থীরাও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধায় সমান অংশীদার হতে পারবে। প্রাথমিক উৎসাহ-উদ্দীপনায় কয়েক বছরের মধ্যেই নিউ স্কীমের শিক্ষার্থীরা তাদের উৎকর্ষের প্রমাণ দিয়েছিলেন।

নিউ স্কীম শিক্ষাধারার জয়-জয়কার অবস্থা। এই পদ্ধতি চালু হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশেই ২১৪টি মাদ্রাসা ছিল, তার মধ্যে ১১টি সিনিয়র। এই ১১টির মধ্যে ৪টি ছিল সম্পূর্ণ সরকারী, বাকি ৬টি ছিল আধা-সরকারী বা অনুদান প্রাপ্ত ও ১টি ছিল শুধু অনুমতি প্রাপ্ত। জুনিয়র মাদ্রাসাসমূহের মধ্যে ১টি ছিল সরকারী ও ১২৯টি ছিল আধা-সরকারী ও বাকি মাদ্রাসা ছিল অনুমতি প্রাপ্ত। নিউ স্কীম শিক্ষাধারা প্রবর্তনের সাথে সাথে আধা-সরকারী ও অনুমতি প্রাপ্ত ৭টি মাদ্রাসার ৬টি মাদ্রাসাতেই নিউ স্কীম গ্রহণ করে। শুধু হুগলী জেলার বিখ্যাত পীর শাহ সূফী আবু বকর রাঃ এর ফুরফুরা মাদ্রাসা নিউ স্কীম চালু করা থেকে বিরত থাকে। (বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৮৬-১৮৭)

সরকারী নোটে বলা হয়েছিল, যেসব মাদ্রাসা নতুন স্কিম গ্রহণ করবে, সরকারী সাহায্য মঞ্জুরের বেলায় সেসব মাদ্রাসাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। কিন্তু যেসব মাদ্রাসা এই স্কিম গ্রহণ করবে না সেসব মাদ্রাসাকে সম্পূর্ণরূপে সরকারী সাহায্য হতে বঞ্চিত করা হবে–এমন কথা কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। কিন্তু কার্যত এটাই হল। ফলে যেসব মাদ্রাসা নতুন স্কিম গ্রহণ করেছিল, সেসব মাদ্রাসা সরকারী সাহায্য লাভে সমর্থ হয়। আর যেসব মাদ্রাসা পুরনো রীতি ও পাঠ্য পুস্তক আঁকড়ে থাকল সেসব মাদ্রাসা সরকারী সাহায্য থেকে বঞ্চিত হল। এমনকি এই সব মাদ্রাসার ছাত্ররা সরকারী বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলল। ১৯১৫-১৭ সালের মধ্যে এই ধরনের কোন মাদ্রাসাকেই বোর্ডের অধীনস্থ গণ্য করা হয়নি।

নতুন স্কিম প্রবর্তনের শর্ত আরোপ করে পুরনোপন্থী মাদ্রাসাকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র চলছে বলে মনে হল। কিন্তু বোর্ড ও সরকারী সাহায্য বঞ্চিত এইসব মাদ্রাসার সংখ্যা দিন দিন না কমে বরং আরো বাড়তে লাগল। ধর্মভীরু ও রক্ষণশীল মানুষের মনে এই নতুন স্কীমের প্রতি আস্থা কমে আসতে লাগল। আরবী শিক্ষার নামে ইংরেজি শিক্ষার এই প্রাধান্য জনগণের মনে একটি জগাখিচুরি পাকিয়ে তুলতে লাগল। ক্রমান্বয়ে সকলের মনে পুরনো শিক্ষার প্রতি মমত্ববোধ জেগে উঠতে লাগত। ইংরেজি ও আরবী মিশ্রিত এই নতুন শিক্ষার ফলশ্রুতি হিসাবে ছাত্ররা না পাশ্চাত্য শিক্ষায় স্কুলের ছাত্রদের মতো পারদর্শী হত, না পুর্বেকার আরবী ছাত্রদের মত ধর্মীয় প্রতিভা লাভ করতে পারত। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা নিজেদের ব্যক্তিগত চেষ্ঠায় প্রদেশের নানা স্থানে পুরনো পাঠ্যরীতি অনুযায়ী খারেজী মাদ্রাসার পত্তন করতে লাগল এবং উত্তরোত্তর এইসব মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়তে লাগল। এতে প্রমাণিত হয় যে, এই দেশের লোকদের ধর্মের প্রতি কতখানি টান রয়েছে।

১৯১৫ সালে নতুন স্কীম প্রবর্তিত হওয়ার পরে, খাঁটি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করার মত কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া আর কোন মাদ্রাসা ছিল না। এই সময় সরকার আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্য বিষয়ের সামান্য রদবদল ও পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই মাদ্রাসার পাঠ্য বিষয়ের উৎকর্ষ এতখানি সাধন করতে হবে যে, এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করা পর যেন ছাত্রদেরকে অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে না হয়। এই উদ্দেশ্য ১৯১৫ সালে প্রিন্সিপাল হারলীর সভাপতিত্ত্বে একটি ‘মোহামেডান এডভাইজারী কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠিত হয়। এবং এই কমিটির মাধ্যমে কিছু রদবদল প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু এই রদবদল এত ব্যাপক ভিত্তিতে ছিল যে, শেষ পর্যন্ত তা আর কার্যকরী হতে পারে না। ফলে এই পরিবর্তন অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর অনেক কাল পর, ১৯২১ সালে এই পরিবর্তনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। ফলে সৈয়দ শামসুল হুদাকে সভাপতি নির্বাচন করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। (আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ১৭৫-১৭৭)।

এটাও ঠিক যে, এই নতুন শিক্ষাধারা বাস্তবায়নের ফলে মুসলিম সমাজের কিছু অংশে উৎসাহের সঞ্চার হয়। এতদিন ইংরাজি শিক্ষার সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন যে, সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়াবে না স্কুলে? নিউ স্কীম শিক্ষাধারা এই সমস্যার একটি সমাধান এনে দিয়েছিল। এই শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন স্কুলের সাধারণ বিষয়ের সমকালীন শিক্ষাধারার সাথে পরিচিত হতে পারবে, তেমনি ধর্মীয় জ্ঞানেও পারদর্শী হতে পারবে। অন্যদিকে আরেক শ্রেণীর মানুষের মনে হতে লাগল যে, নিউ স্কীম শিক্ষাধারা হচ্ছে সরকারের একটি সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র। তাই নিজেদের দ্বীন ধর্মের সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে দেশের আনাচে-কানাচে নতুন নতুন মাদ্রাসা গড়ে তুলতে লাগল।

এ কথাও সত্য যে, নিউ স্কীমের অতি উৎসাহের ফলে অনেক জুনিয়র মাদ্রাসা স্কুলে পরিণত হয়েছে আবার অনেক সিনিয়র মাদ্রাসা কলেজে পরিণত হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ১৮৭৩ সালে হাজী মুহাম্মাদ মুহসিন ফান্ডের টাকা দিয়ে ঢাকায় যে মাদ্রাসা করা হয়েছিল, ১৯১৯ সালে তা স্বতঃস্ফুর্তভাবে ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজে পরিণত হয়। কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ১৯৪৭ সালে পুর্ব পাকিস্থানে এসে উক্ত কলেজের বারান্দায় দশ বছর অতিবাহিত করেও ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পায়নি। বর্তমানে তা একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পরিণত হয়েছে (বর্তমানে কবি নজরুল কলেজ)। একইভাবে ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হুগলী ও চট্রগ্রাম মাদ্রাসাও প্রথমে ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজ ও পরে সাধারণ কলেজে পরিণত হয়। (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৮২-১৮৯)

শামসুল হুদা শিক্ষা কমিশন

১৯২১ সালে মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ সমস্যাদি ও ইসলামী শিক্ষার সংরক্ষণের লক্ষ্যে সৈয়দ শামসুল হুদাকে সভাপতি করে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির আলোচ্য বিষয় ছিল : মাদ্রাসার সাধারণ ব্যবস্থাপনা, আরবী বিভাগের প্রচলিত শিক্ষা বিষয়, মাদ্রাসার আরবী বিভাগের শিক্ষক মণ্ডলীর যোগ্যতা, দায়িত্ব ও শিক্ষকদের সংখ্যা, আরবী বিভাগের ছাত্রদের ভর্তি যোগ্যতা, ও ভর্তির বয়স, পরীক্ষা। এই কমিটির প্রথম অধিবেশনে দুই সাব কমিটি গঠন করা হয়। একটি কমিটি মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও অপর কমিটি মাদ্রাসার শিক্ষা পাঠ্য বিষয়াদি সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করা জন্য। এই কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট জনশিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টরের সমীপে পেশ করা হয় অনুমোদনের জন্যে। রিপোর্টের কিছু প্রস্তাব ছিল নিম্নরূপ–
১. সরকারের উদ্দেশ্য আলিয়া মাদ্রাসায় এমন সব ছাত্রদের জন্য শিক্ষা চালু থাকবে, যারা প্রকৃত অর্থে পরবর্তীকালে ধর্মযাজক বা ধর্মীয় নেতা হবে। কিন্তু কমিটি এ ব্যাপারে মনোভাব পোষণ করেন যে, যেসব ছাত্র এখনকার শিক্ষা সমাপনের পর ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে পরিচয় লাভ করতে চায় তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে।
২. মাদ্রাসার আরবী বিভাগ সম্পর্কে বলা হয়, এই বিভাগের ব্যর্থতার মূলে নিম্নলিখিত কারণগুলি বিশেষভাবে কার্যকরী–১. সামঞ্জস্যপুর্ণ পাঠ্য বিষয়ের ত্রুটি। ২. ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক রামপুর, দেওবন্দ বা দারুন-নাদওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত নিবিড় ও আন্তরিকতাপূর্ণ নয়। ৩. বই-পুস্তক রচনা ও গবেষণার ব্যাপারে ছাত্রদের উৎসাহিত করা হয় না।

শিক্ষাক্রম সম্পর্কে এই কমিটির প্রস্তাব ছিল :
*জুনিয়র ও সুনিয়র প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার মাধ্যম উর্দু হবে এবং অন্যান্য উচ্চতর ক্লাসগুলির আরবী সাহিত্য আরবী ভাষার মাধ্যমে পড়াতে হবে।
*১৯১৭ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন আলিয়া মাদ্রাসাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত করার সুপারিশ করেছিলেন। এই কমিটি উক্ত সুপারিশ কার্যে পরিণত করার জন্য খুবই সচেষ্ট ছিলেন। যাতে ছাত্ররা সহজেই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বৈষয়িক ব্যাপারে অগ্রসর হতে পারে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্নিবেশিত হওয়ার পূর্বে, মাদ্রাসার ইংরেজি শিক্ষার উৎকর্ষ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি নিম্নলিখিত প্রস্তাবলী উপস্থাপন করেন–
ক) মাদ্রাসার যেসব ছাত্র ইংরেজিকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে জুনিয়র চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়বে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রিক মানের ইংরেজি সাহিত্যের বিষয়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং এর বিনিময়ে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের এই মর্ম একটি সার্টিফিকেট দেওয়া হবে যে, সে শুধু ইংরেজি বিষয়ে মেট্রিক পাস করেছে।
খ) এসব ইংরেজি সনদপ্রাপ্ত ছাত্ররা যখন টাইটেল ক্লাসে উঠবে, টাইটেল ১ম বর্ষের সময় আই. এ. ও টাইটেল দ্বিতীয় বর্ষের সময় বি. এ. ইংরেজি বিষয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং তাদেরকেও অনুরপভাবে শুধু ইংরেজিতে আই. এ. ও বি. এ. –র সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে।
গ) ইংরেজিতে বি এ পাস করার পর, ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী, ফার্সি অথবা ইংরেজিতে এম এ ক্লাসের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং বি এল ক্লাসে ভর্তির সুযোগ দিতে হবে।
ঘ) মাদ্রাসার যেসব ছাত্র শুধু ইংরেজি পরীক্ষা দিয়ে বি এ, এম এ পাস করার সুযোগ লাভ করবে তাদের মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের সমতুল্য জ্ঞান করতে হবে। সরকারী চাকুরীর বেলায়ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মতো তাদের সমান অধিকার থাকবে, বিশেষত আরবী, ফার্সি অধ্যাপক নিয়োগের বেলায় তাদেরকে প্রাধান্য দিতে হবে।
ঙ) আরবী, ফার্সি ও উর্দু শিক্ষা দেওয়ার জন্য এমন অধ্যাপক নিয়োগ করতে হবে যাদের মাতৃভাষা আরবী, ফার্সি ও উর্দু।
চ) বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাবিদকে আমন্ত্রণ করে, বিভিন্ন মূল্যবান বিষয়ের উপর বক্তৃতার আয়োজন করতে হবে।
ছ) একজন অধ্যাপক একই বিষয়ে বিভিন্ন ক্লাসে শিক্ষাদান করবেন, একই অধ্যাপককে একাধিক ভাষা বা বিষয়ের জন্যে নিয়োগ করা চলবে না।
জ) ৫০ টাকা হারে ৫টি রিচার্স স্কলারশিপ প্রবর্তন করা উচিত। ছাত্রদেরকে মাদ্রাসার উচ্চতর ক্লাস পাস করার পর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাঠাগারে বিভিন্ন বিষয় গবেষণা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হবে।
ঝ) এংলো-পার্সিয়ান বিভাগের সর্বশেষ স্বরুপ এই দাঁড়িয়েছে যে, এটা একটি সাধারণ হাইস্কুলের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। কলিকাতা মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার সমতুল্য এই স্কুলের শিক্ষার মান। এই স্কুলের নিয়ম-কানুন অন্যান্য হাইস্কুলের মতো প্রায় একই ধরণের। (আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ১৮১-১৯০)

শিক্ষাক্রম সম্পর্কে বিভিন্ন দিকের প্রস্তাব এই কমিটির মাধ্যমে পেশ করা হয়, যেমন কমিটির রিপোর্টে বলা হয় : ইউনানী চিকিৎসা বা অন্য কোন চিকিৎসা শাস্ত্র এই কোর্সের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। যেহেতু আরবি সাহিত্য, অলংকার শাস্ত্র, মুসলিম আইন, ফিকাহ, হাদিস, তাফসীর, তর্কশাস্ত্র, দর্শনের পরিপূর্ণ জ্ঞান না থাকলে ইসলামী শিক্ষা, তাহজিব-তমদ্দুন অপূর্ণ থেকে যায়, তাই এসব বিষয়ও শিক্ষার বিশেষ দরকার আছে, এছাড়াও মেট্রিকুলেশন মান পর্যন্ত ১০টি শ্রেণীতে পাটি গণিত, জ্যামিতি, ম্যাপ ও গ্লোবের সাহায্যে পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞান দানের মত পুর্ণাংগ পাঠ্যসূচী গ্রহণের সুপারিশ করা যায়। ইউনানী কোর্স ছাড়া সরকার উক্ত কমিটির পাঠ্যসুচির অন্যান্য সকল প্রস্তাব প্রশংসার সাথে গ্রহণ করেন। (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৯৩)

মুসলিম এডুকেশন এডভাইজারী কমিটি ১৯৩১ (মোমেন কমিটি)

১৯৩১ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি খান বাহাদুর মৌলভী মোমেনকে সভাপতি করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট মুসলিম এডুকেশন এডভাইজারী কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটি ৪ বছর ধরে বিভিন্ন বৈঠকে মিলিত হয়ে মুসলমানদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপর একটি রিপোর্ট ১৯৪৩ সালের ২২শে নভেম্বর পেশ করেন। মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে সেই রিপোর্টের কিছু প্রস্তাব ছিল নিম্নরূপ
১. পুর্বেকার নিউ স্কীম মাদ্রাসা চালু থাকবে, তবে এ ব্যাপারে কিছু রদবদলের দরকার আছে।
২. নতুন স্কীম ভুক্ত মাদ্রাসা ও ওল্ড স্কিম মাদ্রাসার মাঝে পাঠ্যগত একটি সামঞ্জস্য থাকতে হবে, যাতে ছাত্ররা ইচ্ছানুযায়ী হাইস্কুল বা উক্ত মাদ্রাসায় পারস্পরিকভাবে ভর্তি হতে পারে।
৩. নতুন স্কীমভুক্ত জুনিয়র ও হাই মাদ্রাসায় ইংরেজি, ভর্ণাকুলার এবং অংক ইংরেজি হাইস্কুল বা মাধ্যমিক স্কুলের সমমানের হতে হবে। (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৯৭)
৪. জুনিয়র মাদ্রাসায় উর্দু ভাষাকে বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ্য করা যাবে না, তবে প্রয়োজন বোধে বাংলার বদলে উর্দুকে ভর্ণাকুলারের মর্যাদা দিতে হবে।
৫. চতুর্থ শ্রেণী হতে আরবি বিষয় চালু করতে হবে।
৬. মাতৃভাষার মাধ্যমে দীনিয়াত শিক্ষা দিতে হবে।
৭. তিব্বিয়া চিকিৎসা ক্লাস খোলার জন্য অচিরেই জরুরী বন্দোবস্ত করতে হবে। (আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ১৯৭)

মওলা বখস কমিটি

নিউ স্কীম মাদ্রাসার অধিকংশই বর্তমান বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। নিউ স্কীম মাদ্রাসাসমূহের সরকারী সাহায্য পেতে কোন অসুবিধা ছিল না, তবে ওল্ড স্কীম মাদ্রাসাসমূহে সরকারি সাহায্য পাওয়া খুব মুশকিল ছিল। অবশেষে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ১৯৩৭ সালে ওল্ড স্কীম মাদ্রাসার ব্যাপারে সদয় হলে ওল্ড স্কীম মাদ্রাসার সাহায্য পাওয়ার পথ সুগম হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কারের জন্য খান বাহাদুর মোঃ মওলা বখশকে সভাপতি করে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন।

উক্ত কমিটি ৬৮টি সুপারিশ সম্বলিত একটি খসড়া সরকারের নিকট পেশ করেন। সেই সুপারিশমালার উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এই যে, কলিকাতায় একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, যা প্রচলিত ওল্ড স্কীম, নিউ স্কীম ও ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজসমূহের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৯৯)

মওলা বখস কমিটি সারা সেশের বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের উদ্দেশ্যে একটি দীর্ঘ প্রশ্নপত্র পেশ করেন। বিশেষ উল্লেখযোগ্য প্রশ্নাবলীর ধারাগুলি ছিল নিম্নরূপ–
– ওল্ড স্কিম মাদ্রাসায় ইংরেজিকে ঐচ্ছিক, না বাধ্যতামূলক করা হবে।
– ওল্ড স্কিম মাদ্রাসায় উর্দু ভাষার প্রাধান্য কতটুকু থাকবে।
– ওল্ড স্কিম মাদ্রাসায় বাংলা ভাষা কতটুকু থাকবে।
– হস্তশিল্প ও অন্যান্য কারিগরি বিষয় এই মাদ্রাসায় চালু করা উচিত হবে কিনা।
– ওল্ড স্কিম মাদ্রাসা বর্তমান কালের উপযোগী কিনা, উপযোগী না হলে কী পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
– আপনি কি এই কথা বিশ্বাস করেন যে, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার পর সেকেন্ডারি স্কুলগুলিতে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
– মাদ্রাসায় চিকিৎসা বিজ্ঞান (তিব্বিয়া) প্রবর্তন করা হবে, না এই জন্য আলদা একটি তিব্বিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এই প্রশ্নপত্র প্রদেশের সকল উৎসাহী শিক্ষাবিদের নামে প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৬৮ জন এসব প্রেরণ করেছিলেন। এই জবাবে সুপারিশ ছিল নিম্নরূপ–
– নিউ স্কিম সম্পুর্ণ তুলে দিয়ে ওল্ড স্কিম ব্যবস্থা রাখতে হবে –এর স্বপক্ষে ৭৮ ভোট ছিল।
– ওল্ড স্কিম বন্ধ করে নিউ স্কিম চালু রাখার পক্ষে ১৫ ভোট ছিল।
– উভয় ব্যবস্থায় চালু রাখতে হবে, তবে কিছু সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে–এই স্বপক্ষে ৭০ ভোট ছিল।
– উভয় ব্যবস্থায় তুলে দিয়ে নতুন ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার পক্ষে ৫ ভোট ছিল।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে এই কমিশনের পরিকল্পনা কার্যকর করার সুযোগ হয়ে ওঠে না। (আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, পৃঃ ১৯৯-২০০)

এইভাবে আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশের শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন কমিটি, কমিশনের সুপারিশ, পরামর্শ, প্রস্তাবাবলীর মধ্যে দিয়ে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন ও সংস্কার ধারা চলতে থাকে।

আগের সংবাদভারতের জেলেকে আটক করায় বিএসএফের গালাগালি ও গুলিবর্ষণ, বিজিবির পাল্টা গুলিতে নিহত ১ বিএসএফ জওয়ান
পরবর্তি সংবাদবরুড়ায় আলেমদের উদ্যোগে মাদক ও জুয়া-বিরোধী র‌্যালী সম্পন্ন