রাগিব রব্বানি
হিন্দুত্ববাদী বিজেপি শাসনের ছত্রছায়ায় ভারতজুড়ে নিদারুণ নিপীড়নের শিকার মুসলমানেরা। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটিতে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক মুসলিম নির্যাতনের ঘটনা খবরের শিরোনাম হচ্ছে। নানা কায়দায় কোনঠাসা করা হচ্ছে মুসলমানদেরকে।
আসামে নাগরিকত্ব আইনের মারপ্যাঁচে একদিকে যেমন লাখ লাখ মুসলমানকে গৃহহারা করার পাঁয়তারা চলছে, অপরদিকে কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নিয়ে জনপদটির ওপর দখলদারত্বের নয়া ষড়যন্ত্র সফলতার মুখ দেখছে।
ভারতীয় মুসলমানদের নিদারুণ এ সংকটকালে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালনে কাউকেই তেমন একটা তৎপরতা বা প্রচেষ্টা চালাতে দেখা যাচ্ছে না। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ ভারতের সর্ববৃহৎ মুসলিম সংগঠন। ইংরেজদের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে যেমন তাদের অবদান আছে, তেম্নি ইংরেজ বিতাড়ন ও স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠায়ও আছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
কিন্তু স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে মুসলমানদের বৃহত্তম ও প্রভাবশালী এ সংগঠনটি হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতার জোরে নিজেদের প্রভাব হারাতে থাকে। ফলে রাজনৈতিকভাবে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে ভারতের মুসলমানেরা।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও সংগঠনটির নেতারা বিভিন্ন ব্যানারে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন। সেকুলার দল হিসেবে পরিচিতি দেওয়া রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সাথে একরকম জোটবদ্ধ হয়ে জমিয়ত এ যাবত কাল রাজনীতি করে এসেছে। কিন্তু কংগ্রেস সেকুলারিজমের বুলি আওড়ালেও তাদের কাজকর্ম হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন নয়। বিভিন্ন মেয়াদে তাদের শাসনামলে মুসলিমরা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছে। দাঙ্গার আবরণে হয়েছে গণহত্যার শিকারও।
ভারতীয় মুসলমানদের বর্তমান নির্যাতন-নিপীড়নে বক্তব্য-বিবৃতির বাইরে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের খুব একটা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না। মুসলিম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য দেওয়া হয়, তাও অনেক নমনীয় ও আপোষকামী ভাষায় দেওয়া হয়।
জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন খলিফায়ে মাদানি সিলেটের হজরত কৌড়িয়া রহ.-এর ছোট সাহেবজাদা মাওলানা মাসুম আহমদ। ফাতেহ টোয়েন্টি ফোর থেকে তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের বর্তমান তৎপরতা সম্পর্কে।
মাওলানা মাসুম আহমদ বলেন, বিজেপি প্রথমবার সরকার গঠন করেছিল ১৯৯৯ সালে। যা ২০০৪ পর্যন্ত ছিল। এর আগ পর্যন্ত কংগ্রেস পার্টির বিরুদ্ধে তেমন মজবুত কোনো পার্টি সামনে আসেনি। এদিকে জমিয়ত সবসময় কংগ্রেসের সাথে মিলে কাজ করেছে। কারণ কংগ্রেস হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত হলেও তারা কখনো ধর্মীয় রাজনীতি করেনি। সবসময় ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সামনে রেখেই পথে চলেছে। এখনো তাদের এই পলিসি। এদিকে বিজেপি উগ্র হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত দল। তারা হিন্দু জাতীয়তাবাদের স্লোগান দিয়ে ভারতের আভ্যন্তরীণ পরিবেশ, যা স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যথেষ্ট শান্ত ছিল, মোটামুটি ঘোলাটে করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত কংগ্রেস টানা ২ মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলো। ওই সময় বিজেপি হিন্দু রাষ্ট্রের শ্লোগান দিয়ে নিজেদের কাজ যথেষ্ট গুছিয়ে নিয়েছিল। যার ফলে মোদি তুমুল সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও ২০১৪ সালে বিজয়ী হয়ে গিয়েছিল। ২০১৯ সালে আগের চেয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে। বিজেপির এই হিন্দু রাষ্ট্রের শ্লোগানের বিপরীতে জমিয়ত নিয়মিত ‘কওমি একজেহেতি কনফারেন্স’ আয়োজন করছে। ওইসব সেমিনারে দেশের সেকুল্যার মানসিকতার নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এবং বারবার এই ম্যাসেজ দেয়ার চেষ্টা করা হয় যে, ভারত একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র আর বিজেপির ধর্মীয় রাজনীতি সংবিধান-বিরোধী।
মাসুম আহমাদ বলেন, ছোট ছোট সেমিনার প্রত্যেক এলাকাতেই হয়। আর ২/৩ মাস পরপর বড় ধরনের সেমিনার হয়। এর পাশাপাশি জমিয়ত মূলত ১৯৪৭-এর পর থেকেই সামাজিক সংগঠন হিসেবে কাজ করে আসছে। সরাসরি তারা রাজনীতি করে না। এই হিসেবে বিজেপির উগ্র হিন্দু ধর্মীয় রাজনীতির বিপরীতে জমিয়তের রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি নেই। তবে তারা কংগ্রেসের সাথে মিলে পুরো দেশেই কাজ করেন। যদিও সরাসরি দলের নামে কাজ হয় না বলে রাজনৈতিক ফোকাস তেমন একটা পড়ে না।
খলিফায়ে মাদানি হজরত কৌড়িয়ার কনিষ্ঠ এ সাহেবজাদা বলেন, আরেকটা তথ্য বলা দরকার। ভারতে বিজেপির এই উত্থান কিংবা মোদির বারবার বিজয়ী হওয়া জনগণের ভোটে নয়, বরং সেখানকার প্রায় সব মিলিওনিয়ার বড় ধরণের দুর্নীতির সাথে জড়িত। অনেকেই হাজার হাজার কোটি রুপি আত্মসাৎ করে দেশের বাইরে চলে গেছে। বিজেপি সরকার এসব দুর্নীতিবাজদের সহায়ক। এবং এদের সহায়তায়ই সুক্ষ্ম একটা কারচুপির মধ্য দিয়ে বিজেপির এই ক্ষমতারোহণ।
জমিয়তের বর্তমান কর্মধারা সম্পর্কে মাওলানা মাসুম বলেন, জমিয়ত এই মুহূর্তে মুসলমানদের শিক্ষা, বাসস্থান ও আইনি সহায়তা প্রদানকে সবচেয়ে বেশি প্রাদান্য দিচ্ছে। বছরখানেক হলো মাহমুদ মাদানি জমিয়ত ইউথ ক্লাব নামে একটা শাখা খুলেছেন। যার অধীনে দেশের মুসলমান যুবকদের কারাটেসহ বিভিন্ন রকমের শারীরিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
মাসুম আহমাদ বলেন, আমার যেটা মনে হয়, জমিয়ত আপাতত দেশের মানুষকে সচেতন করতে চাইছে। আর রাজনৈতিক লড়াই তো কংগ্রেসের সাথে মিলে করতে চেষ্টা করছে। যদিও সর্ববৃহৎ দল হয়েও কংগ্রেস নিজেই এখন কোনঠাসা। এবং এই কোনঠাসা হবার মূল কারণ তো বলেছিই, হিন্দুত্ববাদীদের সিন্ডিকেট। তাই এই মুহূর্তে জমিয়ত যা করছে, এরচেয়ে বেশি কিছু করা হিন্দুশাসিত ভারতে আত্মঘাতেরই নামান্তর হবে।