‘স্বাধীনতার সূচনা ইনশাআল্লাহ’র মাধ্যমে, সমাপ্তি আল্লাহর রহমত-এ’

রাগিব রব্বানি:

চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। পাকিস্তানের দখলদারি থেকে এ দেশের মাটি ও মানুষের মুক্তির ৪৯ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। ৪৯ বছর আগে এ দেশের মানুষেরা ছিল পাকিস্তানের অধীনে। তারও আগে শাসন করে গেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা। ব্রিটিশদের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ব বাংলার জনগণ একীভূত হয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে।উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম-বান্ধব একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ যেখানে সর্বাগ্রে সুরক্ষিত হবে। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই দেখা গেল এ দেশের মানুষ সংগ্রাম শুরু করেছে। প্রথমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য, তারপর স্বাধিকারের জন্য। দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর অবশেষে পাকিস্তানের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন একটি দেশ, বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশের এই যে স্বাধীনতা অর্জন, বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল? প্রশ্ন করেছিলাম চট্টগ্রামের ওসমান গনি কলেজের অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালেদকে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য স্বাধীনতা অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কারণ, আমরা যে অঞ্চলে বসবাস করছি, তা ছিল পশ্চাৎপদ। এক সময় এখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, ছিল না বিচার-আদালতের কোনো সুব্যবস্থা। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় হলো, বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার খানিকটা বন্দোবস্ত হলো, এক সময় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের অবসান ঘটল, ৪৭ সালে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হলাম। কিন্তু তারপরও পূর্ব বাংলার মানুষ অবহেলিতই রয়ে গেল।শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি-বাকরি, চিকিৎসাসেবা—সবদিক দিয়েই আমাদের পশ্চাদপদ করে রাখে পাকিস্তানিরা। তাই ৪৭ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত আমাদের ভেতরে বঞ্চনার একটা ক্ষত তৈরি হয়। বাংলা ভাষায় কথা বলি, আমাদের ভাষাটা পর্যন্ত তারা মেনে নিতে রাজি হয়নি। ফলে বায়ান্নের নজিরবিহীন ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের আগরতলা মামলা, গণঅভ্যুত্থান, আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন—এভাবে ধাপে ধাপে আমরা স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাই এবং একাত্তরে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনি আজকের এই দিনে। বাঙালি মুসলমানরা মুক্তি পায় পাকিস্তানি দুঃশাসনের জাঁতাকল থেকে।’

কিন্তু পাকিস্তান তো প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই, তারপরও কেন বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হবার প্রয়োজন বোধ করলো? এ প্রশ্নের জবাবে আ ফ ম খালেদ বলেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য, কথা ঠিক। হজরত আশরাফ আলি থানভি (রহ.), মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানি (রহ.)-সহ থানভি ঘরানার আলেমগণ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হবার পর যে উদ্দেশ্যে এর প্রতিষ্ঠা সে উদ্দেশ্যের ওপর রাষ্ট্র থাকতে পারেনি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার চর্চা সেখানে সঠিকভাবে হয়নি। নেওয়া হয়নি ইসলামিক কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও কোনো উদ্যোগ। প্রায় শুরু থেকেই সেনাদের স্বৈরশাসনে দেশ পরিচালিত হয়ে এসেছে। এবং এখনও সেই ধারার প্রভাব পাকিস্তানে প্রকট। যার ফলে মুসলমানরা, বিশেষত বাংলাদেশের মুসলমানরা হতাশ হয়ে পড়ে রাষ্ট্রের প্রতি। পাশাপাশি বাংলাদেশের মুসলমানরা বঞ্চিত হতে থাকে নিজেদের জীবনযাপনের মৌলিক অধিকার থেকেও। যেমন এখানে কোনো ধরনের শিল্পায়নের উদ্যোগ নিতে চাইত না কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন নিরঙ্কুশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেন, পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী তাঁর কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা, তারা ক্ষমতাও হস্তান্তর করেনি। পাঞ্জাবি সেনাচক্র নিয়ে উল্টো আরও হামলে পড়ল বাংলাদেশের আপামর জনতার ওপর। পঁচিশে মার্চের ভয়ঙ্কর কালো রাতের সৃষ্টি করল, তখন এ দেশের মুসলমানদের জন্য স্বাধীনতা অর্জন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ইসলামের কল্যাণের নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সেখানে ইসলামিক কল্যাণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না, আবার আমাদের ওপর জুলুমও করা হবে, স্বাধীনতা ছাড়া তখন আর উপায় কী!’

ড. খালিদ বলেন, ‘ডা. পিনাকি ভট্টাচার্য লিখিত ‘মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম’ বইতে পাকিস্তানি স্কলার আল্লামা তকি উসমানির একটা উদ্ধৃতি আনা হয়েছে। সেখানে আল্লামা তকি উসমানি ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের সমালোচনা করে বলেছেন, সে সময় নয়টা মাসে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর কেয়ামতের তাণ্ডব চালিয়েছিল। মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারি মুক্তিযুদ্ধের সময় হজরত হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)—যিনি ছিলেন হজরত থানভির খলিফা এবং থানভি ঘরানার প্রত্যক্ষ সমর্থনে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল—তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হুজুর, একদিকে ইসলামের স্বার্থ রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান, আরেক দিকে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধ, আমরা কোন দিকে যাব? হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) তখন স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা জালেম, মুক্তিযোদ্ধারা মজলুম, আমরা মজলুমদের পক্ষ হয়েই কাজ করব। এ উদ্ধৃতিটাও আমি দিলাম পিনাকি ভট্টাচার্যের ‘মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম’ বই থেকে। সেখানে রেফরেন্সসহ এর বিবরণ দেওয়া আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘৭১ সনে যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়, ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। এবং দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর যখন দেশ স্বাধীন হয়, তখন বিপ্লবী সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট রেডিওতে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন, ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহর রহমতে নয় মাস যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। আল্লাহর ওপর ভরসা করে এখন আমরা দেশকে সমৃদ্ধশালী করব।’ কথাটা ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ তৃতীয় খণ্ডে আছে। যে দেশের স্বাধীনতার সূচনা হয়েছে ‘ইনশাআল্লাহ’র মাধ্যমে, সমাপ্তি ঘটেছে ‘আল্লাহর রহমত’-এ এবং সমৃদ্ধশালী হচ্ছে ‘আল্লাহর ওপর ভরসা’ করে, সে দেশের মুসলমানদের কোনঠাসা করে রাখার কোনো সুযোগ নেই। এবং সে দেশের মুসলমানরা সবসময়ই মাথা উঁচু করে থাকবে।’

আগের সংবাদআগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিববর্ষের মেয়াদ বাড়ল
পরবর্তি সংবাদজালেম বনাম মাজলুম, মুক্তিযুদ্ধ ব্যাখ্যায় তৃতীয় মত