রাকিবুল হাসান নাঈম:
বাংলাদেশের সুফি ধারাগুলোর মধ্যে বাড়ছে শিয়া প্রভাব। শিয়াদের রুসম-রেওয়াজ ও বিশ্বাসের প্রভাব তাদের বয়ান-বক্তৃতায় সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে বিভিন্ন আয়োজন ও সেমিনারে। শিয়ারা মূলত হজরত আলী রা.-এর শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাকেই খেলাফতের প্রথম ও একমাত্র উত্তরাধিকারী মনে করে। তারা আহলে বাইতের সদস্যগণকে শরীয়তের মারজা তথা কেন্দ্রবিন্দু মনে করে। আহলে বাইতের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক জুলুম হয়েছে, তারা তার স্মৃতিচারণ করে সবসময়। বাংলাদেশের সুফি ধারাগুলোর মধ্যেও এই প্রভাবগুলো বাড়ছে। নিঃসংকোচে তারা বলছেন, আহলে বাইতকে ভালোবাসার কারণে যদি তারা শিয়া হয়, তাহলে আমরাও শিয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিয়া মতাদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত বর্তমান ইরান রাষ্ট্র বাংলাদেশে নানাভাবে নিজেদের আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে আসছে তথাকথিত সেই ‘ইসলামি’ বিপ্লবের পর থেকেই। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে এ প্রভাব ও আধিপত্য ধরে রাখলেও এদেশে তাদের আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার কায়দা ভিন্ন। প্রধানত ইরানি দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে এই কাজগুলো আঞ্জাম দেওয়া হয়। ইরানি দূতাবাসের অধীনে জেলা ভিত্তিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে। সেখানে নানাধর্মী আয়োজন-অনুষ্ঠান ও প্রোগ্রাম করা হয়। এগুলোতে ইসলামের লেভেল লাগিয়ে শিয়া মতাদর্শ ও ইরান রাষ্ট্রকে মহান করে দেখানো হয়। ইরানি কার্যক্রম মূলত ইসলামি কার্যক্রম—এমন একটা ম্যাসেজ দেবার চেষ্টা করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে আবার আমন্ত্রণ জানানো হয় দেশের সুফি ধারাগুলোর কর্ণধার ও সুফি ধারার অনুসারীদের। অনুষ্ঠানে তারা শিয়া-সুন্নি ফারাক নাই বলে বক্তব্যও দেন।
যেভাবে শিয়া প্রভাবিত হচ্ছে দলগুলো
শিয়া-সুন্নি ফারাক নাই বলে বিশ্বাস করেন সুরেশ্বর দরবার শরীফের প্রধান গদিনশীন পীর সৈয়্যেদ নূরে আখতার হোসাইন আহমদীনূরী। ২০০৭ সালে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কালচারাল সেন্টারে আয়োজিত গাদীরে খুমের সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসাবে ভাষণ প্রদানকালে তিনি এমন মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, শিয়ারাও কালিমা পড়ে, আমরাও পড়ি। শিয়ারা আহলে বাইতকে ভালোবাসে, আমরাও ভালোবাসি। তারাও মুসলিম, আমরাও মুসলিম। তাদের মাঝে আর আমাদের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই। শিয়া-সুন্নি বলে অনেকেই বিভাজন তৈরী করতে চায়। আহলে বাইতকে ভালোবাসার কারণে যদি তারা শিয়া হয়, তাহলে আমিও শিয়া।’
শিয়ারা যেমন বিভিন্ন সাহাবিদের দোষারোপ করেন, তেমনি অনেক সুফিধারাও আহলে বাইতের প্রতি অতি ভক্তি দেখাতে গিয়ে অন্য সাহাবিদের দোষারোপ করেন। জাকের পার্টির চেয়ারম্যান পীরজাদা আলহাজ্ব মোস্তফা আমীর ফয়সল মুজাদ্দেদী মনে করেন, মুসলমানকে শুধু নামাজি হলেই চলবে না। তাকে হতে হবে হুসাইনি। আমির মুআবিয়া রাজি.-এর নাম শুনে যারা শ্রদ্ধা জানায়, তারা মুসলমান হতে পারে না। তিনি বলেন, ‘মুআবিয়াকে আমি মুসলমান মনে করি না।’
বেরলভিদের মধ্যেও রয়েছে আহলে বাইতকে সম্মান দিয়ে অন্যদের তুচ্ছ করার প্রবণতা। আবুল খায়ের সুলতানপুরী এসোসিয়েশন ২০২১ সালে আয়োজন করে আহলে বাইত সম্মেলন। তাতে সৈয়্যদ মোতাছিম বিল্লাহ সম্পদ সুলতানপুরী বলেন, ‘হক একমাত্র মাওলা আলীর সঙ্গেই আছে। তাই আমরাও মাওলা আলীর সঙ্গে। ‘নারায়ে হায়দারি’ তথা আলী রাজি.-এর নামে নারায়ে তাকবির না দিলে আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘মাওলা আলীই শ্রেষ্ঠ। আমরা কেবল তারই অনুসরণ করব। তার অনুসরণই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আর কারও অনুসরণ করব না। আহলে বাইতের বিরোধিতা যারা করবে, চাই সে যত বড় অলী হোক, আমরা তার শত্রু। এমনকি তিনি যদি সাহাবিও হন।’
বাইতুল মোকাররমে কারবালা বিষয়ক এক সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান ডঃ মাওলানা আতাউর রহমান মিয়াজী বলেন, ‘মাওলা আলীকে মহব্বত করার জন্য যদি আমাকে শিয়া বলা হয়ত, তাহলে আমি সর্বশ্রেষ্ঠ শিয়া। আমরণ আমি, এই শিয়া মতবাদ প্রচারে সব বাধা মোকাবেলা করে কাজ করে যাব।’
যেভাবে শিয়া মতাদর্শ ছড়ায় ইরান
শিয়া মতাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত ইরান নিজেদের মতাদর্শ ও আধিপত্যের ভিতকে আরও মজবুত করতে মুসলিম দেশগুলোতেও জারি রেখেছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। বাংলাদেশেও রয়েছে তাদের মিশন। এদেশে তারা রেডিও তেহরান, পার্স টুডে, ইরান মিরর ইত্যাদি মিডিয়ার সাহায্যে শিয়া মতবাদ এবং ইরানের বর্তমান শাসননীতি ও আধিপত্যবাদকে ইসলামের রঙচঙ মাখিয়ে উপস্থাপন করে।
এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সেমিনার, ওয়েবিনার আয়োজন করে ঢাকাস্থ ইরানি কালচারাল সেন্টার। এরমধ্যে রয়েছে ইরানের কথিত ইসলামী বিপ্লবের স্থপতি ইমাম খোমেনীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ওয়েবিনার, কথিত ইসলামি বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকী সেমিনার, ইরানি কবিদের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। এছাড়াও তারা আয়োজন করে ইরানি ফিল্ম ফেস্টিভাল। ফিল্মের মাধ্যমে যদিও শিয়া মতাদর্শের প্রচার সরাসরিভাবে হয় না, কিন্তু এমনকিছু বিষয়ের সন্নিবেশ থাকে ফিল্মের গল্প ও দৃশ্যে, ইরান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি একধরনের মোহ ও পক্ষপাতিত্ব তৈয়ার করে দেয় দর্শকদের মনে। তারা আরবি ক্যালিগ্রাফির কর্মশালা, ফারসি ভাষা শিক্ষাকোর্সও।
বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও আলেম লেখক-সম্পাদক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, আহলে বাইত কেন্দ্রীক শিয়াদের মতবাদকে নিজেদের কাছাকাছি কিংবা নিজেদের মতের সমর্থক বলে প্রচারের কারণে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়। তারা শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে একটা বিরোধ আছে জানলেও সেই বিরোধকে তারা মনে করে হানাফি-আহলে হাদিস বিরোধের মতো সেরেফ মাযহাবি বিরোধ। এখানে যে আরও ভয়ংকর ব্যাপার জড়িত, ঐতিহাসিকভাবে নানা অপকর্ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অনুঘটক হয়ে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ বিনষ্টে কলকাঠি নেড়ে এসেছে যে এই শিয়া মতবাদের অনুসারীরা, সেসব ব্যাপারে সাধারণ মানুষ একদম গাফেলই থেকে যান। পাশাপাশি তারা ইরানকে মনে করেন, মুসলিম উম্মাহর কল্যাণকামী একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। তাই ইরানি নানাবিধ কর্মকাণ্ডে অবচেতন মনেই তারা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যান। এই সমর্থন এবং সম্মতির জন্যই সাংস্কৃতিক এই তৎপরতা চালায় ইরান। জেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে এসবের বাইরে সুন্নি মুসলমানদেরকে শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী করে তোলার একটা প্রক্রিয়াও চালু ছিল একসময়, এখন সেটা আছে কিনা ঠিক জানি না। এই প্রক্রিয়ায় রাজধানীর মিরপুরের বিহারি পট্টিতেও বেশ অনেক মানুষকে শিয়া মতাদর্শে দীক্ষিত করার অভিযোগ আছে।’